জিম্মি টেকনাফ-উখিয়ার সাধারণ মানুষ  

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভয়ংকর ডাকাত কে এই ছলে উদ্দিন!


কক্সবাজার প্রতিনিধি ৫ মে, ২০২৩ ১০:৪৮ : পূর্বাহ্ণ

মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা ডাকাত-সন্ত্রাসী গ্রুপের বেপরোয়া তৎপরতায় কক্সবাজারের স্থানীয়দের মাঝে দেখা দিয়েছে মহাআতঙ্ক। স্থানীয়রা বলেছেন, দুর্গম পাহাড়ে আস্তানা বা ঘাঁটি গেড়ে স্থানীয়দের একের পর এক অপহরণ, হত্যা-নির্যাতন এবং মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা বেড়েছে ব্যাপকহারে।

অপহরণের পর প্রতিক্রিয়া বুঝতে তারা দুর্গম পাহাড়ে বসে মনিটরিং করে গণমাধ্যমের খবরাখবর। সে অনুসারে নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় করা হয়। এ কারণে ঘর থেকে বের হতেও ভয় পাচ্ছেন টেকনাফ-উখিয়ার সাধারণ মানুষ।

বিশেষ করে টেকনাফের বাহাড়ছড়া, গর্জনবাগান, নোয়াখালীপাড়াসহ আশপাশে আরও কিছু স্থানে রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটি ডাকাত-সন্ত্রাসী গ্রুপ ব্যাপক মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠেছে। যার অন্যতম একজন হোতা হিসেবে নাম এসেছে ‘ছলে গ্রুপ’র। এই গ্রুপের প্রধান রোহিঙ্গা ছলে উদ্দিন বাহাড়ছড়ার একটি পাহাড়ে আস্তানা গড়ে তুলে অপহরণ-মুক্তিপণ, চাঁদাবাজি এবং মাদক কারাবারের শেল্টারদাতা হিসেবে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা এবং স্থানীয়রা।

টেকনাফ সদর থানাধীন একজন স্থানীয় বাসিন্দা নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বৃহস্পতিবার মোবাইল ফোনে বলেছেন, ‘ছলে গ্রুপ’ টেকনাফের শালবাগান পাহাড় (ই/১, ই/২) এলাকায় আস্তানা গড়ে নানা অপকর্ম চালিয়ে ভয়াবহ আতঙ্ক তৈরি করেছে। এই গ্রুপের মূলহোতা মূলত রোহিঙ্গা যুবক হাফিজুর রহমান ওরফে ছলে উদ্দিন (২৮)। তিনি মূলত জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা হিসেবে প্রথমে আশ্রয় নিলেও পরবর্তীতে পাহাড়ে ঘাঁটি গেড়ে ডাকাত হিসেবে আবির্ভূত হন।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, ছলে উদ্দিন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘আরসা’ গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। আরসা নেতা আতাউল্লাহর নির্দেশে অপহরণ, ডাকাতি ও মাদক চোরাচালানের সক্রিয় সদস্য। তিনি জামতলী ক্যাম্পে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের একাধিকবার মহড়া দিয়েছেন বলেও জানা যায়। ছলে উদ্দিন মূলত কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকায় প্রায় ১২ থেকে ১৫ জনের সশস্ত্র একটি গ্রুপ নিয়ে সংঘবদ্ধ অপরাধ চালিয়ে গেলেও রোহিঙ্গা হিসেবে তিনি রেজিস্ট্রেশনভুক্ত নন বলে জানা যায়। এই সলেহ গ্রুপ অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় ছাড়াও অনেককে সাগরপথে মালয়েশিয়া ও ভারতে পাচার করেছে বলে গোপন সূত্রে জানা যায়।

অপরদিকে বাহারছড়ার ইউনিয়নের গর্জনবাগান পাহাড়, নোয়াখালীপাড়া পাহাড়, বড় ডেইল পাহাড়, কচ্ছপিয়া পাহাড়, জাহাজপুরা পাহাড়, হলবনিয়া পাহাড়, শিলখালী পাহাড়ে রোহিঙ্গা ডাকাতদের আস্তানা গড়ে উঠেছে। আরেকটি গ্রুপের আস্তানা এখন জুম্মাপাড়া ও নেচারি পার্ক এলাকায়। এদিকে টেকনাফ স্থলবন্দরের ১৪ নম্বর ব্রিজের পাশে বেতবাগান এলাকার একটি পাহাড়েও শক্তিশালী একটি সশস্ত্র ডাকাত গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

গত রমজান মাসেই এই পয়েন্ট থেকে স্থানীয় অন্তত ১৮ থেকে ২০ জনকে বেতবাগান পাহাড়ের ডাকাতরা অপহরণ করে। অবশ্য নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করে প্রায় সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। রোহিঙ্গা চক্রগুলোকে ধরতে এরই মধ্যে ‘বিশেষ অভিযান’ শুরু হয়েছে বলেও নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

রোহিঙ্গা ডাকাতদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া একাধিক ভুক্তভোগীর স্বজনদের মাধ্যমে জানা গেছে, অপহরণের পর রোহিঙ্গা ডাকাতরা যেসব আস্তানায় তাদের রেখেছিল সেখানে নানা ধরণের প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল। রোহিঙ্গা ডাকাতদের ওই পাহাড়ি আস্তানায় রয়েছে- ল্যাপটপ, টেলিভিশন, মোবাইলফোন, ইন্টারনেটের রাউটার।

সেখানে তারা বিভিন্ন টেলিভিশনের ও পত্রিকার খবর মনিটরিং করে থাকেন। বাংলাদেশের এসব গণমাধ্যমে অপহৃতদের কোনো স্বজন ডাকাতদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে থাকলে সেই স্বজনকে খবর শুনিয়ে শুনিয়ে নির্যাতন করা হয়। সেই নির্যাতনের আওয়াজ শোনানো হয়েছে একাধিক ভুক্তভোগী পরিবারকে।

রোহিঙ্গা ডাকাত চক্রগুলোর তৎপরতার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নারী -শিশুসহ অপহরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার খবর জানতে পেরেছি। আমরা অপহরণকারী ও এর মূল হোতাকে গ্রেফতার করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

এ বিষয়ে কক্সবাজার পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি অপহরণ, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এলাকাবাসীকে নিয়ে বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়েছি। অনেক অপরাধী এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে। ডাকাত সলেহর বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা অপরাধীদের তালিকা করেছি। সে সলেহ হউক বা যেই হউক তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েকদিন আগে বাহারছড়া এলাকায় কলেজছাত্রসহ একই পরিবারের ৭ জনকে অপহরণ করেছিল রোহিঙ্গা ডাকাত চক্র। পরে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে রেহায় পান তারা। এছাড়া একই এলাকায় তার কয়েকদিন পর পানের বরজে কাজ করা চারজন কৃষকও অপহৃত হয়েছিলেন।

এ ধরণের ঘটনা টেকনাফ-উখিয়ায় এখন হরহামেশায় ঘটছে বলেও জানা যায়। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে গোপন তথ্যে অভিযানে গেলে কক্সবাজারের থ্যাংখালী এলাকার দুর্গম পাহাড়ে অস্ত্রধারী ডাকাত-সন্ত্রাসীদের সঙ্গে র‌্যাবের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ