বিষয় :

নিম্নমানের ১০ ইঞ্জিন নিয়ে কারচুপি 

অবশেষে হুন্দাই রোটেমকে জরিমানার সিদ্ধান্ত নিল রেলওয়ে


সকালের-সময় রিপোর্ট  ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ৩:৪৫ : পূর্বাহ্ণ

চুক্তি ভঙ্গ করে রেলের ১০ ইঞ্জিনে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ সংযোজন করেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম। পরে কোম্পানিটি তা স্বীকার করে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিও এর সত্যতা পায়। তা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং ইঞ্জিনগুলো গ্রহণে নানা ধরনের পাঁয়তারা শুরু হয়। তবে অবশেষে হুন্দাই রোটেমকে জরিমানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে।

সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে রেলওয়ে। এতে বলা হয়েছে, ১০ ইঞ্জিন কেনায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত জুনে। সংস্থাটি এ মেয়াদ আর বাড়াতে রাজি নয়। তবে আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত উইন্ড আপ পিরিয়ড রয়েছে। এর মধ্যে অবশ্যই বিল পরিশোধ করতে হবে। তা না হলে আর অর্থ দেবে না এডিবি। ফলে ইঞ্জিনের মূল্য পরিশোধে নতুন জটিলতা তৈরি হবে।

প্রস্তাবে আরও বলা হয়, হুন্দাই রোটেম যেহেতু চুক্তি ভঙ্গ করেছে তাই তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ইঞ্জিনের মূল্যের একটি অংশ জরিমানা হিসেবে কেটে রেখে বাকি বিল পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

প্রকল্প পরিচালক হাসান মনসুর এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করে দ্রুত মূল্য পরিশোধ করা জরুরি। কারণ ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় আছে এডিবির ঋণ ছাড় করার। এর মধ্যে বিল পরিশোধ না করলে নতুন জটিলতা তৈরি হবে। তবে হুন্দাই চুক্তি ভঙ্গ করায় তাদের বিরুদ্ধে পেনাল্টির (জরিমানা) সুপারিশ করা হয়েছে। এখন উইন-উইন অবস্থা তৈরি হয়েছে। মন্ত্রণালয়ও প্রস্তাবটি নিয়ে ইতিবাচক। আশা করা যায়, দ্রুতই এ জটিলতা নিরসন হবে।

যদিও ইঞ্জিনগুলো গ্রহণে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে না রেলওয়ে। সূত্রমতে, সরকারি কোনো ক্রয়ের ক্ষেত্রে চুক্তি ভঙ্গ হলেও তা গ্রহণের জন্য সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (সিসিজিপি) ও সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট ইউনিটের (সিপিটিইউ) মতামত নিতে হয়। কিন্তু রেলের ১০ ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে তা নেয়া হচ্ছে না।

বরং দুর্নীতি আড়াল করতে তৃতীয় একজন ব্যক্তির মাধ্যমে ইঞ্জিনগুলো ক্রয় প্রক্রিয়া রিভিউ করা হয়েছে। বর্তমানে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের প্রস্তাব রেলপথ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পরই ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করা হবে।

তথ্যমতে, ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনায় হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে ২০১৮ সালের ১৭ মে চুক্তি করে রেলওয়ে। গত বছর আগস্টে ইঞ্জিনগুলো দেশে আসে। তবে নিম্মমানের ইঞ্জিন সরবরাহের কারণে অর্থ পরিশোধ আটকে দেন তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক। নিম্মমানের ইঞ্জিন গ্রহণে অস্বীকৃতিও জানান তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রেলপথ সচিবের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ওই কমিটি।

এতে বলা হয়, ইঞ্জিনগুলো তৈরিতে কারিগরি শর্ত অনুসরণ করা হয়নি। ইঞ্জিন, অলটারনেটর, কম্প্রেসার ও ট্রাকশন মোটরএ চারটি ক্যাপিটাল কম্পোনেন্টস চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়নি। ফলে টেস্ট রানের সময় ইঞ্জিনের ব্রেক হর্সপাওয়ার ২২০০বিপিএইচ ও ট্রাকশন হর্সপাওয়ার ২০০০টিএইচপি হওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া যায় যথাক্রমে ২১৭০বিপিএইচ ও ১৯৪২টিএইচপি।

এজন্য হুন্দাই রোটেম ও সিসিআইসিকে অভিযুক্ত এবং চুক্তি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। তবে কোম্পানি দুটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। উল্টো ইঞ্জিনগুলো চালানোর উপযুক্ত কিনা তা যাচাইয়ের জন্য ২৩ মার্চ কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। সম্প্রতি এ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কারিগরি কমিটি।

এতে বলা হয়েছে, হুন্দাই রোটেমের সরবরাহকৃত ১০ ইঞ্জিন চালানোয় কোনো সমস্যা নেই। শুধু ইঞ্জিন ঘুরানোর সময় কিছুটা সমস্যা হয়। তবে বর্তমান অবস্থায় ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের সুযোগ নেই। তবে ইন্ডিপেনডেন্ট রিভিউয়ারের মাধ্যমে যাচাই করে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে।

কারিগরি কমিটির রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্ডিপেনডেন্ট রিভিউয়ার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে আহসান জাকির নামে এক সাবেক আমলাকে। তিনি এক্ষেত্রে ইতিবাচক মতামত দেন।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক হাসান মনসুর বলেন, ইন্ডিপেনডেন্ট রিভিউয়ার ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছে। তবে গোপনীয়তার স্বার্থে তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। ওই প্রতিবেদনসহ ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন করলে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ ও চালানো শুরু করা হবে।

সরকারি ক্রয় কমিটিতে প্রস্তাব পাঠানো হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার কোনো প্রয়োজন নেই। মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন গ্রহণ করলেই যথেষ্ট। সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রস্তাব পাঠিয়ে জটিলতা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না।

প্রসঙ্গত, ১০ ইঞ্জিনের চুক্তি মূল্য ছিল তিন কোটি ৭৯ লাখ ৬৩ হাজার ৪০০ ডলার। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম দেয়া হয়। বাকি অর্থের মধ্যে ইঞ্জিনগুলো দেশে আসার পর ৬৫ শতাংশ ও গুণগত মান যাচাই শেষে বাকি ১০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের কথা ছিল। যদিও নি¤œমানের ইঞ্জিন সরবরাহের কারণে পুরো প্রক্রিয়া আটকে দেন প্রকল্পটির তৎকালীন পরিচালক নূর আহম্মদ হোসেন।

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ