পরিবেশ অধিদপ্তরের ৩ মামলা...

“পাহাড়খেকো” কাউন্সিলর জসিমের রাম রাজত্ব!


মোহাম্মদ ফোরকান  ৮ নভেম্বর, ২০১৯ ৬:৫৩ : অপরাহ্ণ

রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া ঢাকার কাউন্সিলররা একেরপর এক গ্রেফতার হলেও চট্টগ্রামের কাউন্সিলররা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। এ কে এম আবিউল হকের ছেলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম। তিনি সরকারি জমিতে গৃহ নির্মাণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে অল্প সময়ের মধ্যেই বিপুল অর্থবিত্ত ও সম্পদের মালিক বনে গেছেন।

সরকারি পাহাড় কেটে, শতাধিক প্লট বিক্রি করে হয়েছেন কোটিপতি। পাহাড়ের শত বিঘা সম্পত্তির মালিক জসিম। তবে তার সম্পদের দিকে কারও নজর দেয়ার সাহস নেই। এমনকি নেই তার উপরে কথা বলার কেউ। কারণ, সন্ত্রাসীদের কাছে পর্যন্ত তিনি ‘পাহাড়ের রাজা’ সাধারণ মানুষ তো ছাড়!

পাহাড় কাটার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ৩টি মামলা হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরে। একটি মামলার চার্জশিটও দাখিল করা হয়েছে। তার নেতৃত্বে রয়েছে একটি শক্তিশালী সন্ত্রাসী গ্রুপ। এ গ্রুপের মাধ্যমে সে প্রকাশ্যে পাহাড় কেটে প্লট তৈরি ও বিক্রি করছেন।

এছাড়া ও তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলা ও জিডি রয়েছে বলে জানা যায়। নানা অপকর্মের পরেও আছেন কাউন্সিলর জসিম বহাল তবিয়তে। বিভিন্ন সময় পাহাড় ধসে হতাহতের পর আলোচনায় আসেন “ভূমিদস্যু” এই কাউন্সিলরের নাম।

সম্প্রতি নগরীর আকবর শাহ থানার ইস্পাহানী ১নং গেইট এলাকায় জমি দখলের ঘটনায় আবারো আলোচনায় আসেন “পাহাড়খেকো” এই কাউন্সিলরের নাম। তার নিরুদ্ধে দখল বাণিজ্যসহ চাঁদাবাজির অভিযোগ অহরহ। কেবল পাহাড় কাটা নয়, নিজের ওয়ার্ডে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়েও বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় প্রশাসনকে মেনেস করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে গত ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে ইস্পাহানী ১ নম্বর গেইট পাহাড়িকা সিএনজি পাম্পের পূর্বপাশে স্থানীয় বসতিদের উচ্ছেদের চেস্টা করেন সে। এ সময় স্থানীয়রা বাঁধা দিলে পুলিশ জসিমের কথাই বসবাসকারীদের মারধর করেন। এমনকি পুলিশের এক জন এস.আই বসতির নারীদের ওড়না, শাড়ি টেনে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন বলেও জানা যায়।

সূত্র জানায়, ১১ মে নগরীর অলঙ্কার মোড়ে ভাংচুর ও লুটপাটের অভিযোগে জসিমের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন পাহাড়তলী থানা আ’লীগ সভাপতি নুরুল আবছার মিয়া।

তিনি বলেন, গত ৯ মে কাউন্সিলর জসিম উচ্ছেদ অভিযানের নামে (চসিক)কে ব্যবহার করে আমার নিজস্ব সম্পত্তিতে ভাংচুর ও লুটপাট চালান। এতে ২০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়। অপর একটি উচ্ছেদ অভিযানের নামে মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে তার বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও হকাররা ৬ জুন বিক্ষোভ করে।

আরো জানা যায়, কাউন্সিলর জসিম নগরীর আকবর শাহ থানাধীন বিশ্ব কলোনি ও ফয়’স লেক এলাকায় পাহাড় কেটে শতাধিক প্লট করে কাঠাপ্রতি ২/৩ লাখ টাকা করে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়া বিশ্বকলোনি এলাকার সেভেন মার্কেটের প্রায় দেড়শ’ দোকান থেকে অবৈধভাবে মাসে প্রায় ৪/৫ লাখ টাকা চাঁদা নেন।

দুই’শ অবৈধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচলে অনুমতি দিয়ে হাতাচ্ছেন প্রতিমাসে ২ লক্ষ টাকা। এসব অটোরিকশা কর্নেলহাট সিডিএ আবাসিক এলাকার ১ নম্বর রোড থেকে ইস্পাহানী গেট পর্যন্ত চলাচল করে।

রেলের জায়গায় পাহাড়তলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ পরিচালনা নিয়েও তার বিরুদ্ধে রয়েছে অনেক অভিযোগ। কমিটির সভাপতি থাকার সুবাদে ৬ তলা কলেজ ভবনকে অর্ধেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। আবার এই ভবনে দুটি কোটি টাকার দোকানও রয়েছে তার।

সূত্র জানায়, কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্থানীয়দের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি হামলা ও মামলার ঘটনা অনেক। এ নিয়ে এলাকার মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। স্থানীয়রা বলেছেন, নানা অভিযোগে অভিযুক্ত এ কাউন্সিলর আওয়ামী লীগের জন্য কলঙ্ক ও একটি আতঙ্ক!

জানা যায়, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জসিম ও পাহাড়তলী আওয়ামী লীগ নেতা সরওয়ার মোরশেদ কচি গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলছে। এ বিরোধের জেরে হামলার শিকার হয়েছেন মুসা মিয়ার ছেলে যুবলীগ নেতা মহসিন। আহত মহসিনকে সন্ত্রাসী দাবি করে জসিম তখন বলেছিলেন, মহসিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৮টি মামলা রয়েছে। সে পেশাদার ছিনতাইকাররী ও ইয়াবা ব্যবসায়ী।

তবে এ বিষয়ে মহসিন বলেন, কাউন্সিলর জসিমের অনুসারী ক্যাডাররা আমার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। জুয়েল, তুহিন, রাব্বী, পারভেজ, ফারহান ও খোকনসহ ১০-১২ জন আমাকে মারধর করে। মরে গেছি ভেবে ওরা আমাকে ফেলে রেখে চলে যায়।

তিনি আবার পূর্ব ফিরোজশাহ আবাসিক এলাকায় বঙ্গবন্ধু চত্বরে গড়ে তোলেছেন নিজের নামে ম্যূরাল ও মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের ম্যুরাল। আর অপর পাশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাত বীরশ্রেষ্ঠের ম্যুরোল। তবে এলাকায় প্রবেশের মুখেই শোভা পাচ্ছে কাউন্সিলরের ম্যুরাল।

স্থানীয়রা কাউন্সিলরের এ ধরনের কর্মকান্ডের ব্যাপারে বিরূপ মনোভাব পোষন করে বলেন, সাধারণত স্মরণীয়-বরণীয় জাতীয় নেতৃবৃন্দ, জাতীয় বীরদেরই ম্যুরাল হয়। কিন্তু এখানে নিজের ম্যুরাল বানিয়ে কাউন্সিলর চরম ঔদদ্ধপূর্ণ আচরনের বহি প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

এসব অনৈতিক কর্মকান্ড সরকার ও দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করারই শামিল, কিন্তু এলাকায় কাউন্সিলরের প্রভাবের কারণে কেউ এ নিয়ে মুখ খুলার সাহস পাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, কাউন্সিলর জসিম ইতিপূর্বে এলাকায় বিভিন্ন নানা অপকর্মে জড়িত থেকে এলাকায় দুর্নাম কুড়িয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার একরামুল হক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন শ্রেনীর নেতারা জানান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে একজন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর এর ম্যুরাল কোন অবস্থায় শোভা পায় না এতে করে জাতির জনক এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন নয় বরং মানসিকতার অবক্ষয় বলে আখ্যা দিয়েছেন।

স্থানীয়রা বলেন, কাউন্সিলর জসিম রাজনীতি করেছেন মানুষের সেবা করার জন্য নয়, নিজের জন্য। তা না হলে কাউন্সিলর নির্বাচনের ২ মাসের মাথায় কোটি টাকার গাড়ি ও ৬ মাসের মাথায় ৫ তলা বাড়ি কেমন করে করেছেন?

এ প্রসঙ্গে আকবরশাহ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আলতাফ হোসেন বলেন, জসিমের বিরুদ্ধে পাহাড়তলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আবছার মিয়ার করা মামলা ভিন্ন খাতে নিতেই ৬ জুন হকার উচ্ছেদের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায় কাউন্সিলর জসিম। অলংকার মোড়ের হকাররা উচ্ছেদের প্রতিবাদ করতে গেলে সাধারণ জনগণের রোষানলে পড়েন তিনি।

এ ব্যাপারে পাহাড়তলী থানার ওসিকে একাদিক বার কল দিলে তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে জসিমেরর ব্যাপারে স্থানীয়রা বলেন, নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং দ্বন্দ্বের জেরেও অনেক মামলা-পাল্টা মামলা হয়েছে থানায়। তার বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগও রয়েছে।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক সকালের-সময়কে বলেন, পাহাড় কাটার অভিযোগে কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে আকবরশাহ থানার ৩টি মামলার মধ্যে একটির অভিযোগপত্র গত ১৫ মার্চ দাখিল করা হয়েছে। বাকি দুটি পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে। জসিমের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর অভিযোগের অন্ত নেই।

এ বিষয়ে ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জহুরুল আলম জসিম সকালের-সময়কে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ করা হচ্ছে সব মিথ্যা, আমি কোন পাহাড় দখল করিনি, আপনি প্রয়োজনে থানায় খবর নিতে পারেন। আপনি এসে দেখে যান, তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের ৩ মামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। আপনি আমার অফিসে আসেন এক কাপ চা খেয়ে গেলে খুশি হব বলে লাইন কেটে দেয়।

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ