বিষয় :

নিম্নমানের ১০ ইঞ্জিনের ২০৭ কোটি টাকা আটকে দিল রেল কর্তৃপক্ষ


সকালের-সময় রিপোর্ট  ২০ মে, ২০২১ ৩:০১ : পূর্বাহ্ণ

দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের সরবরাহকৃত ১০ মিটারগেজ ইঞ্জিনে দরপত্রের শর্তানুসারে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়নি। নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি করা এসব ইঞ্জিনের মূল্য প্রায় ৯ মাস ধরে আটকে রাখা হয়েছে।

তবে লকডাউনের মধ্যে গত সপ্তাহে ইঞ্জিনগুলোর ৬৫ শতাংশ প্রায় ২০৭ কোটি টাকা পরিশোধের উদ্যোগ নেন নতুন প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর। যদিও রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বাধায় তা আটকে গেছে।

তথ্যমতে, নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহের কারণে হুন্দাই রোটেমের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। তবে দুই মাস পেরিয়ে গেলেও কোম্পানিটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করতে তাড়াহুড়ো করা হচ্ছে। এজন্য গত মাসে নিয়োগ দেয়া হয়েছে নতুন প্রকল্প পরিচালক।

এদিকে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় গত ৫ এপ্রিল সীমিত আকারে লকডাউন তথা চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। সে সময় সরকারি প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আর ১৪ এপ্রিল থেকে চলাচলের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা (লকডাউন) আরোপের পর সরকারি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

এতে রেলওয়ের সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনা করে যাচ্ছে রেলওয়ে। যদিও লকডাউনের মাঝেই কোরিয়া থেকে আনা নিম্নমানের ১০ ইঞ্জিনগুলো পুনরায় ট্রায়াল রান (পরীক্ষামূলক চালানো) করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকটি ইঞ্জিন দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে কনটেইনারবাহী ট্রেন চালানো হয়েছে।

আর ঈদুল ফিতরের আগেই গত সপ্তাহে ইঞ্জিনগুলোর মূল্য বাবদ চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ অথাৎ ২০৭ কোটি টাকা অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৮ মে সকালের-সময় ডটকম অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, ফের নিম্নমানের ১০ ইঞ্জিন নিয়ে প্রকল্প পরিচালকের কারসাজি, ‘সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রে পিছু ছাড়ছে না রেলওয়েকে’ শিরোনামে নিউজ প্রকাশিত হলে কর্মকর্তাদের টনক নড়ে। তারা ইঞ্জিনের মূল্য পরিশোধ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেন।

এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল ফোন রিসিভ করেননি।

তবে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনের চুক্তি মূল্যের ৬৫ শতাংশ অথাৎ ২০৭ কোটি টাকা পরিশোধের প্রস্তাব মহাপরিচালকের কাছে পাঠালেও তিনি রাজি হননি। তিনি এ প্রস্তাব ফেরত দেন ও কারিগরি কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন।

তথ্যসূত্রে জানা যায়, ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে ২০১৮ সালের ১৭ মে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চুক্তিমূল্য ছিল তিন কোটি ৭৯ লাখ ৬৩ হাজার ৪০০ ডলার বা প্রায় ৩১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম দেয়া হয়। বাকি অর্থের মধ্যে ইঞ্জিনগুলো দেশে আসার পর ৬৫ শতাংশ বা ২০৭ কোটি টাকা পরিশোধের কথা।

আর গুণগত মান যাচাই শেষে বাকি ১০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের শর্ত ছিল। তবে নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহের কারণে চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ অর্থ আটকে দেন প্রকল্পটির তৎকালীন পরিচালক নূর আহম্মদ হোসেন।

নিম্নমানের ইঞ্জিন গ্রহণে অস্বীকৃতিও জানান তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। এতে হুন্দাই রোটেম ও প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেক্টর সিঙ্গাপুরের সিসিআইসিকে অভিযুক্ত করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ইঞ্জিনগুলো তৈরিতে কারিগরি শর্ত অনুসরণ করা হয়নি। ইঞ্জিন, অলটারনেটর, কম্প্রেসর ও ট্রাকশন মোটর এ চারটি ক্যাপিটাল কম্পোনেন্টস চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়নি। ফলে টেস্ট রানের সময় ইঞ্জিনের ব্রেক হর্সপাওয়ার ২২০০বিপিএইচ ও ট্রাকশন হর্সপাওয়ার ২০০০টিএইচপি হওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া যায় যথাক্রমে ২১৭০বিপিএইচ ও ১৯৪২টিএইচপি।

সূত্র জানায়, রেলপথ সচিবের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে দুই মাসের বেশি সময় ধরে তা গোপন করে রাখা হয়েছে। আর হুন্দাই রোটেম বা সিসিআইসি কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

যদিও ২৩ মার্চ আরেকটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয় ইঞ্জিনগুলো চালানোর উপযুক্ত কি না যাচাইয়ের জন্য। এর এক সপ্তাহ পর ১ এপ্রিল আগের প্রকল্প পরিচালককে বদলি করে দেয়া হয়। আর ৪ এপ্রিল থেকে নতুন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন মোহাম্মদ হাসান মনসুর। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর ইঞ্জিনগুলো নতুন করে ট্রায়াল রানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ হাসান মনসুর বলেন, কারিগরি কমিটিতে ইঞ্জিনগুলোর তথ্য উপস্থাপনের জন্য ট্রায়াল রান করা হচ্ছে। প্রতিটি ট্রিপ শেষে এগুলোর পারফরম্যান্স, ট্রাভেল টাইম, সর্বোচ্চ গতি ইত্যাদি নোট রাখা হচ্ছে। কারিগরি কমিটি এগুলো দেখে যে সুপারিশ করবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

লকডাউনের মাঝেই ইঞ্জিনের মূল্য পরিশোধের বিষয়ে তিনি বলেন, ১০ ইঞ্জিন কেনা প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী জুন পর্যন্ত। তাই এর আগেই ইঞ্জিনের মূল্য পরিশোধ করে প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অন্যথায় তা আরও এক বছর ঝুলিয়ে রাখতে হবে। তবে লকডাউনের কারণে প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে।

সূত্র: এসবি

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ