বিষয় :

ঐতিহাসিক নিদর্শনের মাঝে ‘জান্নাতুল বাকি’ অন্যতম


সকালের-সময় রিপোর্ট  ১৩ এপ্রিল, ২০২০ ১১:৪৫ : অপরাহ্ণ

মদিনায় অবস্থিত জান্নাতুল বাকি একটি ঐতিহাসিক কবরস্থান, আরবিতে যাকে ‘বাকিউল গারকাদ’ বলা হয়। মদিনাবাসীর কাছে বাকি কবরস্থান নামেই পরিচিত। জান্নাতুল বাকি মসজিদে নববীর পূর্ব দিকে অবস্থিত। নবী করিম (সা:) এর স্মৃতিবিজড়িত এই শহর পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের বুকে ধারণ করা এই খবর স্থান সারা বিশ্বের মুসলমানের কাছে আজ সমাদৃত। মদিনায় নবী করিম (সা:) এর সময়ের অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শনের মাঝে ‘জান্নাতুল বাকি’ অন্যতম।

দাফনকৃত মৃতের সংখ্যা

ইমাম মালিক (রহ.)-এর মতে, জান্নাতুল বাকিতে প্রায় ১০ হাজার সাহাবার কবর রয়েছে। কিন্তু কোনো কবর চিহ্নিত নয়। নবী করিম (সা.)-এর পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য থেকে শুরু করে সাহাবা, পীর-আউলিয়া, বুজুর্গ এবং অসংখ্য মুসলমানের কবর রয়েছে জান্নাতুল বাকিতে।

কবরস্থানের সূচনা

জান্নাতুল বাকির সূচনা হয় নবী করিম (সা.)-এর পবিত্র হাতেই। তাঁর দুধভাই উসমান ইবনে মাজউন (রা.) মারা গেলে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, ‘তাকে কোথায় দাফন করা হবে?’ তিনি বলেন, ‘আমাকে আদেশ দেওয়া হয়েছে তাকে বাকিউল গারকাদে দাফন করার জন্য।’ (মুসতাদরাকে হাকিম : ১১/১৯৩) তাই বলা যায়, কবরস্থানের জন্য জায়গাটি আল্লাহর পক্ষ থেকেই নির্বাচিত। সর্বপ্রথম উসমান ইবনে মাজউন (রা.)-কে দাফন করা হয়। তারপর কবরস্থান তিন দিকেই প্রশস্ত হতে থাকে। আর আজ তা বিশাল জায়গাজুড়ে বিস্তৃত।

জান্নাতুল বাকিতে সমাহিত ব্যক্তির বিশেষ মর্যাদা

বরকতময় এই কবরস্থানে সমাহিত ব্যক্তির সৌভাগ্য বোঝার জন্য এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে মৃতদের দাফনের জায়গাটি স্বয়ং আল্লাহ তাআলা নির্বাচন করেছেন। এ ছাড়া হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির জমিনে চিড় ধরবে, সেই ব্যক্তি আমি। তারপর আবু বকর (রা.), তারপর ওমর (রা.), তারপর আহলে বাকি। আমি আহলে বাকির পাশে থাকব। তারা আমার সঙ্গে একত্র হবে। তারপর আমি মক্কাবাসীর জন্য অপেক্ষা করব। তারা মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি জায়গায় এসে আমার সঙ্গে মিলিত হবে। (সুনানে তিরিমজি, হাদিস : ৩৬২৫)

জান্নতুল বাকি বাসীর জন্য নবী করিম (সা.)-এর ভালোবাসা

বাকি কবরস্থানে দাফনকৃতদের জন্য নবী করিম (সা.)-এর বিশেষ মমতা ও ভালোবাসা ছিল। মাঝেমধ্যেই তিনি রাতের বেলা একাকী এসে শায়িত লোকদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি ঘটনা সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়। হাদিসে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এক রাতে হজরত আয়েশার ঘরে অবস্থান করছিলেন।

গভীর রাতে তিনি উঠে জান্নাতুল বাকিতে যান এবং দীর্ঘক্ষণ দোয়া করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে না পেয়ে খুঁজতে বের হন এবং জান্নাতুল বাকিতে দোয়ারত অবস্থায় তাঁকে দেখতে পান। তিনি এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে মহানবী (সা.) তাঁকে বলেন, জিবরাঈল (আ.) আমাকে বলতে লাগলেন, আপনার রব আপনাকে হুকুম করছেন, আপনি (জান্নাতুল) বাকিবাসীদের কাছে যাবেন এবং তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করবেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯৭৩)

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য হাদিসে এসেছে, ‘রাসুল (সা.) আমার বণ্টিত নির্ধারিত দিন আমার কাছে থাকা অবস্থায় রাতের প্রায় শেষাংশে উঠে বাকিতে চলে যেতেন। এবং বলতেন, হে মুমিন শহরবাসীরা! তোমাদের ওপর সালাম বর্ষিত হোক। কালই তোমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতির বস্তু পাচ্ছ। তোমরা (কিয়ামতের জন্য) বিলম্ব করছ। ইনশাআল্লাহ! আমরাও অচিরেই তোমাদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছি। হে আল্লাহ! বাকিবাসীকে মাফ করে দাও।

জান্নাতুল বাকিতে ঘুমিয়ে আছেন যাঁরা

জান্নাতুল বাকিতে কবরস্থ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হলেন—নবীকন্যা ফাতেমা (রা.), তৃতীয় খলিফা ও রাসুলের জামাতা উসমান (রা.), উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.), নবীজির চাচা আব্বাস (রা.), নবীপুত্র ইবরাহিম (রা.), নবীদৌহিত্র হাসান (রা.), উসমান ইবনে মাজউন (রা.), নবীকন্যা রোকাইয়া (রা.), খলিফা আলী (রা.), আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), নবীজির দুধমা হালিমা সাদিয়া (রা.) প্রমুখ।

মদিনায় অবস্থানরত হজ পালনকারীদের মৃত্যু হলে এই কবরস্থানে দাফন করা হয়। সেই সঙ্গে মদিনাবাসী এখানে দাফনের সুযোগ পান। এখনো প্রতিদিন এখানে লাশ দাফন করা হয়। তবে বাকি কবরস্থানের সম্মুখভাগে এখন আর নতুন করে কাউকে কবর দেওয়া হয় না। কারণ এ অংশেই রয়েছে সাহাবাদের কবর।

জিয়ারতের সময়

জিয়ারতের জন্য ফজর ও আসরের নামাজের পর জান্নাতুল বাকি খুলে দেওয়া হয়। ফজরের পর তিন ঘণ্টা, আসরের পর এক ঘণ্টা। বিশাল আয়তনের জান্নাতুল বাকির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীরাও যথেষ্ট আন্তরিক।

কবরস্থানের সংস্কার

সৌদি সরকার দুইবার জান্নাতুল বাকি সংস্কার করেছে। প্রথম সংস্কার করেন বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ। এ সময় ‘বাকিউল গামাত’ এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত একটি সড়কও বাকির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। উত্তর দিকেও কবরস্থান সম্প্রসারণ করা হয়। সর্বমোট ছয় হাজার মিটার ভূমি সংযুক্ত হয়। তা ছাড়া বাকির ভেতরে পাকা রাস্তা বানানো হয়, যাতে বৃষ্টির মৌসুমে দর্শনার্থী এবং দাফন করতে আসা লোকদের কোনো ধরনের কষ্ট না হয়। দ্বিতীয়বার সংস্কার হয় বাদশাহ ফাহাদের আমলে।

এ সময় আশপাশের মহল্লা, বাজার, সড়ক—সব কিছু জান্নাতুল বাকির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন জান্নাতুল বাকির চারদিকে এক হাজার ৭২৪ মিটার দীর্ঘ দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে এবং এতে মর্মর পাথর লাগানো হয়েছে। দেয়ালে কালো রঙের লোহার জালি লাগানো হয়েছে। জান্নাতুল বাকির একপাশে মৃতের গোসল দেওয়া এবং কাফন পরানোরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

উসমানি খিলাফতের সময় এবং এরও আগে জান্নাতুল বাকিতে অবস্থিত সাহাবাদের কবরের ওপর নানা ধরনের স্থাপনা ছিল। পরবর্তী সময়ে আরব ভূখণ্ডে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হলে সৌদি কর্তৃপক্ষ এসব স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। বর্তমানে জান্নাতুল বাকির কোনো কবরে নামফলক নেই। তাই বোঝার উপায় নেই কার কবর কোনটা।

সকালের-সময়/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ