দুর্নীতি মামলার আসামি যখন সিপাহি নিয়োগ কমিটির প্রধান!


নিজস্ব প্রতিবেদক ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ২:৫৭ : পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী-আরএনবিতে যেন ভূত চেপেছে। যার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগে মামলা, এবার সেই আসামিই হয়ে উঠলেন ৮০৬ জন সিপাহি নিয়োগ কমিটির প্রধান! তিনি আর কেউ নন পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলাম।

২০১৭ সালে ১৮৫ জন সিপাহি পদে লোক নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে সেই অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা পায় দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। এ কারণে তাঁকে প্রধান আসামি করে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। নিয়োগ বাণিজ্যের জন্য অভিযুক্ত সেই জহিরুলকে আবারও এ নিয়োগ কমিটির প্রধান করায় রেল অঙ্গনে বইছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।

নিয়োগ আর বদলি বাণিজ্য, টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের পদোন্নতি এবং পছন্দের পাত্রদের গুরুদণ্ডের পরিবর্তে লঘুদণ্ড কিংবা দণ্ড মওকুফ করে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে রেলের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে বদলি করা হলেও সেখানে যাননি তিনি। রাতারাতি বদলে যায় সরকারি আদেশ।

জানা যায়–সিপাহি নিয়োগে কোটায় চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে লাভবান হওয়ার জন্য বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নেন জহিরুল ইসলামসহ রেলের পাঁচ কর্মকর্তা। সিপাহি নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা, পোষ্য কোটার প্রার্থীদের পাসের কাছাকাছি নম্বর দিলেও মৌখিক পরীক্ষায় তাঁদের অনুত্তীর্ণ দেখানো হয়।

কোটায় পছন্দের অযোগ্য প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি মৌখিক পরীক্ষায়ও পাস দেখানো হয়। আবার বিভাগীয় কোটা, জেলা কোটাসহ অন্য কোটায় বিধি মেনে নিয়োগ না দিয়ে অর্থের বিনিময়ে অযোগ্যদের চাকরির সুযোগ করে দেওয়া হয়। তদন্তে এমন সব অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর গত ২৮ আগস্ট চট্টগ্রামের একটি আদালতে জহিরুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে আদালতে মামলা দায়ের করেন দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক।

এদিকে– আরএনবির পশ্চিমাঞ্চলের বর্তমান চিফ কমান্ড্যান্ট মো. আশাবুল ইসলামকেও নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতর সেই একই মামলায় আসামি করা হয়েছে। কিন্তু রেলের পশ্চিমাঞ্চলে আরএনবির চারজন এসআই ও ২০ জন এএসআই নিয়োগে যে কমিটি করা হয়েছে, সেই কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে তাঁকে! দুটি কমিটিই করা হয়েছে একই দিনে।

জহিরুল ইসলাম ও আশাবুল ইসলাম ছাড়াও মামলায় আসামি করা হয়েছে বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিবের দায়িত্বে থাকা আরএনবির সাবেক কমান্ড্যান্ট ফুয়াদ হাসান পরাগ, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক এসপিও মো. সিরাজউল্যাহ এবং রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ ফারুক আহমেদকে। অভিযুক্তরা পরস্পরের যোগসাজশে অনিয়ম-দুর্নীতি করেন বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

এবার রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ৮০৬ জন সিপাহি নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য গত ৩০ জুন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-১ অধিশাখার উপসচিব মো. তৌফিক ইমাম স্বাক্ষরিত আদেশে একটি নিয়োগ কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। ওই কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে আরএনবি ঢাকার কমান্ড্যান্ট মো. শহীদুল্লাহকে।

নিয়োগ দুর্নীতির দায়ে মামলা হওয়া চিফ কমান্ড্যান্টকে ফের বড় ধরনের একটি নিয়োগ কমিটির প্রধান করায় বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার সিনিয়র কমান্ড্যান্ট থাকার পরও ঢাকার কমান্ড্যান্ট হিসেবে চলতি দায়িত্বে থাকা মো. শহীদুল্লাহকে কমিটির সদস্য সচিব করার বিষয়টি নিয়েও একইভাবে প্রশ্ন উঠেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আরএনবি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রেলে নিয়োগ নিয়ে সব সময় একাধিক সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকে। রেলের সিপাহি নিয়োগ নিয়েও সক্রিয় হয়ে উঠেছে সিন্ডিকেটগুলো। এ নিয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তরে চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলামের অফিসে গেলে তার দেখা মেলেনি।

এ বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম জাহাঙ্গীর হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নিয়োগ কমিটি করেছে মন্ত্রণালয়। তাই যাঁদের নিয়োগ কমিটিতে রাখা হয়েছে, তাঁদের বিষয়ে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দেবে। আমার কিছু বলার নেই।

এ নিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবিরের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেনি।

সূত্র জানায়, আরএনবির কয়েকটি চৌকি রয়েছে, যেখানে অনিয়মের মাধ্যমে বাড়তি আয়ের সুযোগ রয়েছে। এসব চৌকিতে আরএনবি সদস্যদের বদলিতে অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলামসহ বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। আরএনবির অস্ত্র শাখা হচ্ছে বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। আন্তঃনগরের ট্রেনগুলোতে বাহিনীটির অস্ত্রধারী সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

আর বাহিনীর সদস্যরা সেসব ট্রেনে অবৈধভাবে টিকিটবিহীন যাত্রী তুলে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে থাকেন। তাই আরএনবির লোভনীয় অস্ত্র শাখায় যেতে অর্থের লেনদেন হয়। গত ৮ আগস্ট চট্টগ্রাম স্টেশনে অবৈধভাবে টিকিটবিহীন যাত্রী নিতে গিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেন কয়েকজন আরএনবি সদস্য। টিকিট নিয়ে ট্রেনে উঠছিলেন একজন সেনাসদস্য।

কিন্তু টিকিট থাকার পরও টাকা ছাড়া তিনিসহ কয়েকজন যাত্রীকে একটি বগিতে উঠতে দিচ্ছিলেন না তাঁরা। ওই সেনাসদস্য নিজের পরিচয় দিয়ে প্রতিবাদ করলে আরএনবি সদস্যরা তাঁকে মারধর করার পাশাপাশি বাহিনী সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেন। পরে ঘটনাটি জানাজানি হলে আরএনবির এক হাবিলদারসহ চার সিপাহিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। তাঁরা এখন কারাগারে। এ ছাড়া আরএনবির সাধারণ শাখায় থাকলে গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন এবং রেলের বিভিন্ন জংশনে থাকা দোকানপাট, পার্কিং, হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে থাকেন আরএনবি সদস্যরা।

অভিযোগ রয়েছে, এসব পয়েন্ট থেকে আসা টাকা যায় বাহিনীর উপর মহলেও। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বরে রেলওয়ের পাহাড়তলী লোকোশেডে রেলবিট চুরিকালে তিন চোরকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন কর্মচারীরা। কিন্তু সে সময় ইন্সপেক্টর পদে চলতি দায়িত্বে থাকা ইসরাইল মৃধা মূল আসামিকে ছেড়ে দেন এবং তাকে বাদ দিয়ে মামলা করেন। এ ঘটনায় গত ১৯ জানুয়ারি আরএনবির তখনকার চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমান্ড্যান্ট শফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে শাস্তি হিসেবে তার পাঁচ বছর বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করেন।

কিন্তু চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলাম চলতি দায়িত্বে থাকা সেই ইন্সপেক্টরকে পাঁচ বছরের মধ্যে চার বছর শুধু দণ্ড মওকুফই করেননি, ইন্সপেক্টর পদে নিয়মিত পদোন্নতিও দিয়েছেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে দণ্ড মওকুফ করে মৃধাকে রীতিমতো পদোন্নতি দিয়েছেন। শুধু অষ্টম শ্রেণি পাস হওয়ার পরও মৃধা নামে সেই আরএনবি সদস্যকে পরপর পাঁচ দফায় পদোন্নতি দিয়ে ইন্সপেক্টর বানিয়ে দেন চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলাম।

সূত্র–ডিএসকে/এসএস/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ