দীর্ঘ দুই দশক একইপদে–দেলোয়ারের খুঁটির জোর কোথায়!


মোহাম্মদ ফোরকান  ৩০ মে, ২০২৩ ৭:৫০ : অপরাহ্ণ

মো. দেলোয়ার হোসেন। চাকরি জীবনের শুরুটা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মেরিন বিভাগের সহকারী জাহাজ পরিদর্শক হিসেবে। তার বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এই চাকরি বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর পরের গল্পটা আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্যের গল্পকেও যেন হার মানায়! সহকারী জাহাজ পরিদর্শক থেকে কয়েক বছরের ব্যবধানে বনে গেছেন অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক।

অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি দীর্ঘ দুই দশক ধরে একইপদে বহাল তবিয়তে থাকার কারণে ভয়ে কেউ তার এসব জাল-জালিয়াতি, দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করার সাহস পাননি। চট্টগ্রাম বন্দরে তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তিনি এতটাই প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর যে, তাকে কেউ চাকরি জীবনের শুরু থেকে সরাতে পারেননি।

সম্প্রতি—তার চাকরিতে যোগদানের নথি প্রতিবেদকের হাতে আসলে তাতে দেখা যায়, তিনি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন যা সম্পূর্ণ বেআইনি। নথিতে দেখা যায়, সহকারী জাহাজ পরিদর্শক মো. দেলোয়ার হোসেন ২০০১ সালে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেছেন। এবং ২০০১ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একটা চাকরির বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তিনি চাকরির আবেদন করেন। যথারীতি পরীক্ষা ও যাবতীয় কার্যক্রম পরবর্তী তিনি দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চাকরির প্রবিধান অনুযায়ী মূল সনদ প্রদর্শণ ব্যাতিত চাকরিতে যোগদান সম্পূর্ণ বেআইনি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা ।

এছাড়াও এই নথি অনুযায়ী সহকারী জাহাজ পরিদর্শক হিসেবে যোগদান করলেও পরবর্তীতে তার পদোন্নতি বা অন্যত্র বদলি হওয়ার কথা, কিন্তু তিনি এই পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। উল্লেখ থাকে যে–বিগত বিএনপি-জামাত সরকারের আমলে তাৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাই সাঈদ ইস্কান্দারের প্রত্যক্ষ সুপারিশে বাগিয়ে নেওয়া এই সহকারী জাহাজ পরিদর্শক পদটি যেন তার জন্য সোনার ডিমপাড়া হাঁস।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব জাহাজ রয়েছে প্রায় চল্লিশটারও বেশি এবং এসব জাহাজের মাষ্টার, সহকারী মাষ্টার, ইঞ্জিন ড্রাইভার (ইডি), সুকানি, লস্কর, গ্রিজারসহ কর্মরত বিভিন্ন কর্মচারীদের পদায়ন বা বদলি সংক্রান্ত বিষয়ে রয়েছে তার বিশেষ প্রভাব। প্রতিটি পদায়ন বা বদলিতে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নেওয়ার বিষয়টা ওপেন সিক্রেট।

এছাড়াও বন্দরের নিজস্ব এসব জাহাজের জ্বালানি তেল বরাদ্দ নিয়ে এই সহকারী জাহাজ পরিদর্শক মো. দেলোয়ার হোসেন সক্রিয় কমিশন বাণিজ্যের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। তার এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন ইঞ্জিন ড্রাইভার (ইডি), মাষ্টার, সহকারী মাষ্টার, লস্কর এবং একজন প্রভাবশালী বন্দরের সিবিএ নেতা। প্রতিটি জাহাজে জ্বালানি তেল বরাদ্দের চাহিদাপত্র অনুমোদন করে প্রতি লিটার তেল থেক সাড়ে ৩ টাকা কমিশন নেন বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইঞ্জিন ড্রাইভার (ইডি)।

এই কমিশনের টাকার ভাগ বাটোয়ারায় আনুপাতিক হারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে কমিশন বাণিজ্যটা অফিসিয়াল করে নিয়েছেন এই দেলোয়ার হোসেন। এছাড়াও এই তেল বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে যে কমিশন বাণিজ্য গড়ে তুলেছে তার টাকাগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে বহনের জন্য একটা সমিতির মাধ্যমে সুদের ব্যবসা গড়ে তুলেছেন আরেক দেলোয়ার হোসেন ওরপে জামাই দেলোয়ারের মাধ্যমে। ইতিপূর্বে এই জামাই দেলোয়ার নগদ টাকাসহ প্রশাসনের হাতে আটক হয়েছেন বন্দর ভবনেই।

আরও জানা যায়, সহকারী জাহাজ পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত হলেও জ্বালানি তেল বরাদ্দের কমিশন বাণিজ্য ও পদায়ন-বদলির তদবির বাণিজ্যের টাকায় চট্টগ্রামের আভিজাত এলাকা খ্যাত খুলশিতে প্লট কিনেছেন এবং নিজ জেলা ফেণীতেও নান্দনিক বাড়ি নির্মাণ করেছেন।

চবকের সামান্য সহকারী জাহাজ পরিদর্শক হলেও তিনিই অফিসের সর্বেসর্বা। মেরিন বিভাগের সব টেন্ডার তদবির বাণিজ্য করেন দেলোয়ার। চট্টগ্রাম বন্দরের অসাধু কর্মকর্তা ও সিবিএ নেতার যোগসাজশে এগুলো একাই নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। অফিসের কেউ ভয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইঞ্জিন ড্রাইভার (ইডি) বলেন–দুই দশক ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের মেরিন বিভাগ জিম্মি হয়ে আছে এই দেলোয়ারের হাতে। অথচও ভয়ে কেউ তার এসব দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করার সাহস পাননি। চট্টগ্রাম বন্দরে তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তাই তার কিছু হয়না।

বিষয়টি জানার জন্য মো. দেলোয়ার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটি আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র। আমার পোষ্টে একজন আসতে চাচ্ছে সেই বিভিন্ন জায়গায় চিঠি চালাচালি ও এসব বলে বেড়াচ্ছে।

এছাড়াও উপরোক্ত বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনীয়ার্স এসোসিয়েশন চট্টগ্রাম বন্দরের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, উনার সবকিছু ঠিক আছে কিনা আমার যাচাই হয়ে গেছে। উনার সার্টিফিকেট যাচাই বাচাই করে উনাকে আমাদের সদস্য করা হয়েছে। আশা করি সব ঠিক থাকবে।

এবিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, যদি সহকারী জাহাজ পরিদর্শক মো. দেলোয়ার হোসেন জাল-জালিয়াতি ও কোন অনিয়ম-দুর্নীতি করে থাহলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রিয় পাঠক—মেরিন বিভাগের আরও অনিয়ম-দুর্নীতি ও দেলোয়ারের তেল সিন্ডিকেটের খবর দ্বিতীয় পর্বে দেখুন…।

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ