ব্যর্থতার বেড়াজালে শিপিং করপোরেশন–নেই কাঙ্ক্ষিত গতি!


সকালের-সময়  ৭ মার্চ, ২০২২ ৯:৫৫ : পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম বন্দরে স্বাধীনতার ৫০ বছরে পণ্যের আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে ৪৮ গুণের বেশি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেসরকারি মালিকানায় সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যাও। এখন সমুদ্রে ভাসছে তাদের ৭২টি জাহাজ। আর বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জাহাজের বহর এখনও আটে বন্দি।

সময়ের হাত ধরে নৌবাণিজ্যের পালে হাওয়া লাগলেও সেভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারছে না বিএসসি। ২০২০-২১ অর্থবছরে সমুদ্র বাণিজ্য থেকে বেসরকারি জাহাজ মালিকরা ২ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা আয় করে। অন্যদিকে একই সময়ে বিএসসি আয় করেছে মাত্র ২৭৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

অনুসন্ধানে জানা যায়– বিএসসির এমন পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে রয়েছে আমলানির্ভর প্রশাসন। সমুদ্র বাণিজ্যে দক্ষ জনবল নেই এখানকার পরিচালনা পর্ষদে। এর ফলে সিদ্ধান্ত নিতে দূরদর্শিতা দেখাতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করা ইউক্রেনে ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজ পাঠানোতেও বিচক্ষণতার প্রমাণ দিতে পারেনি বিএসসি। অলভিয়া বন্দরে থাকা নাবিকরা তাদের ফিরিয়ে আনতে ছয়দিন ধরে নানা মাধ্যমে আকুতি জানালেও তা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীলরা।

এক দশকেও পূরণ হয়নি ছয় নতুন জাহাজের স্বপ্ন

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) তাদের বহরে আরও ছয়টি নতুন জাহাজ যুক্ত করার পরিকল্পনা করে এক দশক আগে। দুটি বাল্ক্ক ক্যারিয়ার, দুটি মাদার ট্যাঙ্কার ও দুটি মাদার প্রডাক্ট অয়েল ট্যাঙ্কার কেনার প্রকল্প নিয়েছিল তারা। রামপাল, পায়রা ও মাতারবাড়ীতে তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প ঘিরে ৮০ হাজার টনের দুটি মাদার বাল্ক্ক ক্যারিয়ার কেনার পরিকল্পনা করে তারা। এখনও এটি আলোর মুখ দেখেনি।

জানা যায়–ইস্টার্ন রিফাইনারির ক্রুড অয়েল পরিশোধন ক্ষমতা ভবিষ্যতে দ্বিগুণ হবে। এটি সামনে রেখে অনেক আগে নিজস্ব জাহাজে পরিবহনের জন্য এক থেকে সোয়া লাখ টন ধারণক্ষমতার দুটি নতুন মাদার ট্যাঙ্কার কেনার পরিকল্পনাও নিয়েছিল তারা। আলোর মুখ দেখেনি সেটিও। আমদানি করা ডিজেল ও জেট ফুয়েল পরিবহনের জন্য ৮০ হাজার টন ধারণক্ষমতার দুটি মাদার প্রডাক্ট অয়েল ট্যাঙ্কার গ্রহের পরিকল্পনাও অনেক আগে থেকে জানাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠান। তবে বহরে যুক্ত হয়নি এটিও।

লাভেও পিছিয়ে

বিএসসি গত অর্থবছরে মোট ৭২ দশমিক শূন্য ২ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে। এক বছরে তাদের মুনাফা বেড়েছে ৩০ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদ এ তথ্য জানিয়েছিলেন। বিএসসি আট বড় জাহাজ দিয়ে যে আয় করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আয় করছে বেসরকারি জাহাজ মালিকরা। ২০১৭ সালে বেসরকারি মালিকরা নামিয়েছে ৪টি জাহাজ। ২০১৮ সালে এটির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯।

২০১৯ সালে নতুন জাহাজ নেমেছে ১৫টি। ২০২০ সালে এ সংখ্যা হয় ১৪। ২০২১ সালে নতুন জাহাজ নামিয়েছে ১৮টি। ব্যবসা ভালো বলে ক্রমেই একের পর এক নতুন জাহাজ নামাচ্ছে তারা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের আছে ২৩টি জাহাজ। মেঘনা গ্রুপের ১৫টি আর আকিজ গ্রুপের রয়েছে ১০টি জাহাজ। অন্যান্য গ্রুপের রয়েছে আরও ২৪টি জাহাজ।

আমলানির্ভর পরিচালনা পর্ষদ

বিএসসির পরিচালনা পরিষদে আছেন ১০ সদস্য। ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জারি করা রাষ্ট্রপতির ১০ নম্বর আদেশবলে (সর্বশেষ সংশোধিত) নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হচ্ছেন এ পর্ষদের চেয়ারম্যান। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দু’জন যুগ্ম সচিবসহ বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, তিনজন সার্বক্ষণিক নির্বাহী পরিচালক ও দু’জন স্বতন্ত্র পরিচালকের সমন্বয়ে সর্বমোট ১০ সদস্য নিয়ে গঠিত বিএসসির পরিচালনা পরিষদ। পরিচালনা পর্ষদ পুরোপুরি আমলানির্ভর হওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানে নেই কাঙ্ক্ষিত গতি। পদাধিকারবলে যারা শীর্ষ পদে আছেন তারা সবাই রাষ্ট্রীয় আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ফলে তারা বিএসসিকে সেভাবে সময় দিতে পারেন না।

শিক্ষা বোর্ডের ‘পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক’ এখন বিএসসির নির্বাহী পরিচালক

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এক সময় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছিলেন ড. পীযূষ দত্ত। শিক্ষা ক্যাডারে থাকায় তিনি এ দায়িত্ব পান। পরে প্রশাসন ক্যাডারে যান তিনি। এর পর বিএসসির নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্য) পদে নিয়োগ পান। উপসচিব পদমর্যাদার এ কর্মকর্তা তার চাররিজীবনের সময় কাটিয়েছেন শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে। এখন তিনি আছেন শিপিং করপোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে।

ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকটি পদে আছেন অনভিজ্ঞ লোক। সেই পদগুলো হলো- নির্বাহী পরিচালক (প্রযুক্তি), সচিব, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ও মহাব্যবস্থাপক (নিরীক্ষা)। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ চলছে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে। এর মধ্যে আছে মহাব্যবস্থাপক (ওয়ার্কশপ), উপ-মহাব্যবস্থাপক (কার্গো সুপারভিশন অ্যান্ড অপারেশন) ও উপ-মহাব্যবস্থাপক (চাটারিং ও পরিকল্পনা) পদ।

প্রেষণে নিয়োগ পান ব্যবস্থাপনা পরিচালক

নৌবাহিনীর কমডোর সুমন মাহমুদ সাব্বির ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর প্রেষণে নিয়োগ পান প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে। বেশ কয়েক বছর ধরে নৌবাহিনী থেকেই প্রেষণে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিচ্ছে সরকার।

দায়িত্বশীলরা কে কী বলছেন

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী ও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের চেয়ারম্যান খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তবে এর আগে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ইউক্রেনের ঘটনায় বিএসসির আন্তরিকতায় কোন ঘাটতি ছিল না। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শক্ত হাতে এটি নিয়ন্ত্রণ করেছে বলে নাবিকদের দ্রুততম সময়ে জাহাজ থেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আগের চেয়ে বিএসসি এখন অনেক গতিশীল। বিএসসি এখন প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাভজনকও। বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর সুমন মাহমুদ সাব্বিরও ফোনে সংযুক্ত হননি।

নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্য) ড. পীযূষ দত্ত বলেন, ‘২৩ বছর শিক্ষা ক্যাডারে দায়িত্ব পালন করলেও ৬ বছর ধরে আছি প্রশাসন ক্যাডারে। বিএসসিতে আমি নিয়োগ পেয়েছি ২০২০ সালে। নিয়োগের পর আমরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছি বলে তিন বছর ধরে লাভজনক প্রতিষ্ঠান বিএসসি। লাভের ধারাবাহিকতায় ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে লাভ করেছি ১২৬ কোটি টাকা।

তবে– বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘আমলানির্ভর একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বিএসসি। নৌ বাণিজ্য ক্রমশ বাড়লেও বিএসসি তাদের সেভাবে প্রস্তুত করতে পারেনি। ইউক্রেনের ঘটনায়ও চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানটি।

প্রিয় পাঠক—আগামী পর্বে বিএসসির নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্য) ড. পীযূষ দত্তের মন্তব্যসহ আরো দুটি প্রতিবেদন থাকছে…সাথে থাকুন….।

সূত্র—এসকে/এসএস/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ