পাহাড়ি এলাকায় ভবন নির্মাণের আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের অবস্থানগত ছাড়পত্র নেয়ার নিয়ম রয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন-২০১০-এও স্পষ্টভাবে পাহাড় বা টিলা কাটার ওপর স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা দেয়া রয়েছে। এক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থে পাহাড় কাটার প্রয়োজন দেখা দিলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতির বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।
কিন্তু আইন করেও পাহাড় কাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না চট্টগ্রামে। নগরীর আবাসন খাতের বেশকিছু পাহাড়খেকো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পাহাড় কেটে অভিজাত বহুতল ভবন নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে বিশেষ করে এপিক প্রপার্টিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে। নগরীতে এমন অনেক প্রকল্পের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যেখানে এপিক নির্বিচারে পাহাড় কেটে বহুতল ভবন করলেও কিন্তু পাহাড়ের সামান্যতম চিহ্ন ও রাখেনি।
সরেজমিন দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরীর জাকির হোসেন রোডে দক্ষিণ খুলশি এক নম্বর রোডের প্রবেশ মুখে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ দিকে তাকালে চোখে পড়বে পাহাড় চূড়ায় সুউচ্চ কয়েকটি ভবন। পাহাড়ধস ও ভূমিকম্প দুর্যোগের আশঙ্কায় এ এলাকার মানুষ সব সময় আতঙ্কে থাকে কখন যে ধসে পড়ে এই ভবনগুলো? খাড়া পাহাড়ের তীর ঘেষে এক নম্বর রোডে ‘ক্রাউন রিজ’ নয় তলা উচ্চতার ভবনটির কাজ চলমান থাকলেও পাশে লাগোয়া আরো ২টি ভবনে নির্মাণ কাজ শেষ করেছে এপিক প্রপার্টিজ।
এর আগে চট্টেশ্বরী রোডে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিপরীত পাশের পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে ১৩ তলা উচ্চতার ‘এপিক অঙ্গন’ নামের আরো একটি ভবন। সেই ভবনে ৯৯টি ফ্ল্যাট রয়েছে। পাহাড় কেটে এই দুই ভবন নির্মাণের কারণে বিভিন্ন সময়ে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জরিমানাও গুনতে হয়েছিল এপিক প্রপার্টিজকে।
এখন আবার নগরীর চকবাজার প্যারেড কর্নার এলাকায় পার্সিভিল হিলের সুউচ্চ চূড়ায় বহুতল ভবন নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে এপিক প্রপার্টিজ। এলক্ষ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) থেকে চোরা পথে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র নিলেও বিশেষ প্রকল্পে অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রায় শতাধিক ডেভেলপার ভবন নির্মাণে কাজ করলেও অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এভাবে পাহাড় নিধন করে ভবন নির্মাণে আগ্রহ দেখায়নি।
এবিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পরিবেশবিদ সকালের-সময় ডটকম’কে বলেন, পাহাড় চূড়ায় বহুতল ভবন নির্মাণ করতে গেলে পাহাড় কাটতে হবে। আর পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পাহাড়কে রক্ষার জন্য বলা হয়েছে, তাই আমরা কাউকে পাহাড় চূড়ায় প্রকল্প নেয়ার পরামর্শ দিয়না। তাহলে এপিক কিভাবে পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণ করছে! জানতে চাইলে তিনি বলেন, এপিক প্রপার্টিজকে কিভাবে সিডিএ অনুমোদন দিচ্ছে তা সিডিএ জানে। আপনারা সিডিএ’র কাছে জানতে চাইতে পারেন।
পাহাড়ের চূড়ায় কখনো ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয় না। কিন্তু এই অনুমোদন দিতে গিয়ে পাহাড় আর পাহাড় থাকছে না বলে মন্তব্য করেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিডিএ’র এক নগর পরিকল্পনাবিদ, তিনি সকালের-সময় ডটকম’কে বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বালি মাটির আধিক্য বেশি। তাই এগুলোর চূড়ায় বিধি অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে ভবনের সুরক্ষা করা হয়, যার কারণে পাহাড়ের সুরক্ষা আর হয় না।
সরেজমিন নগর পরিকল্পনাবিদের মন্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায় চট্টেশ্বরী রোডের ‘এপিক অঙ্গনের’ প্রকল্পে। একসময় এই এলাকায় পাহাড় ছিল, তবে বর্তমানে পাহাড়ের চিহ্ন নেই। খুলশি চার নম্বর রোডের পাহাড় চূড়ায় খুলশি ইম্পেরিয়াল হিল নামে একটি বহুতল ভবন রয়েছে। সেখানেও ভবন রয়েছে কিন্তু পাহাড়ের প্রকৃতি আর নেই। খুলশি নাসিরাবাদ প্রপার্টিজ এলাকার বিশাল পাহাড়ি এলাকায় অসংখ্য ভবন গড়ে উঠেছে কিন্তু পাহাড়ের সৌন্দর্য আর নেই।
দক্ষিণ খুলশি এক নম্বর রোড দিয়ে প্রবেশ করার সময় পাহাড় দেখা যাবে কিন্তু সেই পাহাড়ে কংক্রিটের ঢালাই বসছে পাহাড় রক্ষার জন্য। আর পাহাড় চূড়ায় গড়ে উঠছে এপিকের বহুতল ৩টি ভবন ছাড়াও আরো কয়েটি ভবন। কিছুদিন পর এই পাহাড়টিও ঢাকা পড়ে যাবে।
কিন্তু ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের পাহাড় চূড়ায় ভবন নির্মাণ করলেও পাহাড়গুলো অক্ষত ছিল। সার্সন রোডে জয়পাহাড়, চট্টেশ্বরি রোডের পাহাড় , কিংবা রেলওয়ের বাংলোগুলো পাহাড় চূড়ায় গড়ে উঠেছে কিন্তু পাহাড়গুলো এখনো বিদ্যমান রয়েছে।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরীর এক পরিচালক ‘সকালের-সময় ডটকম’কে বলেন, যদি কেউ সিডিএ’র অনুমোদন নিয়ে পাহাড় না কেটে ভবন নির্মাণ করে আমাদের আপত্তি নেই। তবে ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে পাহাড় কাটলেই জরিমানা গুনতে হবে। এজন্য আমরা এপিক প্রপার্টিজকে এর আগেও জরিমানা করেছি।
জরিমানা করলেই কি শেষ? প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, ভবন ভাঙ্গার এখতিয়ার আমাদের নেই। তবে অনুমোদনহীনভাবে পাহাড় কাটলে জরিমানা করা হয়ে থাকে। জরিমানার পর দ্বিতীয় দফায় পাহাড় কাটা হলে তার বিরুদ্ধে পরিবেশ আদালতে মামলা হতে পারে।
এপিক পাহাড়ের চূড়ায় এতো বেশি প্রকল্প নিচ্ছে কেন? জানতে চাইলে একজন পরিবেশবিদ সকালের-সময় ডটকমকে বলেন, চট্টেশ্বরী, খুলশির পর এখন পার্সিভিল হিলে এপিক প্রকল্প নিলেও এর আগে ওমরগনি এমইএস কলেজের পাশের পাহাড়েও একসময় প্রকল্প নিয়েছিল সিডিএ। কিন্তু সেই পাহাড়ে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়নি সিডিএ।
এ বিষয়ে জানার জন্য এপিক প্রপার্টিজের অফিসের মোবাইল ফোনে কল দেয়া হলে আরিফ নামের এক কর্মকর্তা ফোন রিসিভ করে, কিন্তু তিনি সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর প্রতিবেদকের করা প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।
প্রিয় পাঠক, বারবার পাহাড়ের চূড়ায় পরিবেশ বিনষ্ট করে কেন আগ্রাসন চালাচ্ছে এপিক? এ বিষয়ে জানতে আগামী পর্বে চোঁখ রাখুন….
সকালের-সময়/এমএফ