মামুনুল হকের বিরুদ্ধে এবার সোনারগাঁ থানায় ধর্ষণ মামলা


সকালের-সময় রিপোর্ট  ৩০ এপ্রিল, ২০২১ ২:১৫ : অপরাহ্ণ

হেফাজতে ইসলামের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তার দাবি করা দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা। শুক্রবার (৩০ এপ্রিল) নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানায় মামলাটি করেন তিনি।

সোনারগাঁ থানা পুলিশ সূত্র জানায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। মামলার নম্বর ৩০।

মামুনুল হক দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করলেও মামলায় ঝর্ণা নিজেকে মামুনুল হকের স্ত্রী বলেননি। শুক্রবার সকালে একটি মাইক্রো গাড়িতে করে থানায় ঝর্ণার সঙ্গে এসেছিলেন তার বড় ছেলে আব্দুর রহমান জামিও।

জান্নাত আরা ঝর্ণার বাবা ওলিয়ার রহমানকে গত ২৪ এপ্রিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয় ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ। আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর থেকে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এরপর ২৬ এপ্রিল মেয়েকে উদ্ধারে পুলিশের সহায়তায় চেয়ে কলাবাগান থানায় সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করেন তিনি। পরদিন মোহাম্মদপুরের একটি বাসা থেকে ঝর্ণাকে উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ। ঝর্ণা উদ্ধার হওয়ার তিন দিনের মাথায় এই মামলা করলেন।

ঝর্ণাকে আদালতে তোলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আদালতে ২২ ধারায় তিনি ঘটনার বর্ণনা দেবেন। মামলা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।’

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, জান্নাত আরা ঝর্ণা নামে এক নারী মামুনুল হকের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের একটি মামলা দায়ের করেছেন। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।

মামলার এজাহারে ঝর্ণা বলেছেন, ‘আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে মামুনুল হক আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। আমাকে গত দুই বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাঘুরির নাম করে নিয়ে গিয়ে তার পরিচিত বিভিন্ন হোটেল ও রিসোর্টে রাত্রীযাপন ও বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তার যৌন লালসা চরিতার্থ করে। আমি বিয়ের কথা বললে সে আমাকে করবো-করছি বলে নানা অজুহাতে কালক্ষেপণ করতে থাকে।’

গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানাধীন রয়েল রিসোর্টে জান্নাত আরা ঝর্ণাসহ মামুনুল হককে আটক করে স্থানীয় লোকজন। পরে খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হলে ঝর্ণাকে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে দাবি করেন মামুনুল। তার দাবি, স্ত্রীর অধিকার পাবে না, সম্পত্তির অংশীদার হবে না এবং সন্তান ধারণ করবে না- এই তিন শর্তে তিনি ঝর্ণাকে ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে করেছেন তিনি।

এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মামলার এজাহারে ঝর্ণা বলেছেন, ‘সর্বশেষ গত ৩ এপ্রিল আমাকে ঘোরাঘুরির কথা বলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও রয়েল রিসোর্টে নিয়ে আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে অবস্থানকালে স্থানীয় জনগণ আমাদের আকস্মিকভাবে আটক করে এবং আমাদের (মামুনুল হক ও আমার) পরিচয় জানতে চায়। আমরা কোনও সদুত্তর দিতে না পারায় স্থানীয় জনতার রোষাণলে পড়ি। পরবর্তীতে মামুনুল হকের অনুসারীরা রিসোর্টে হামলা করে আমাদের নিয়ে যায়।

এজাহারে তিনি আরও বলেন, ‘এই ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠলে মামুনুল হক আমাকে আমার নর্থ সার্কুলার রোডের ভাড়া বাসায় যেতে না দিয়ে তার পরিচিত একজনের বাসায় অবৈধভাবে জোরপূর্বক আটকে রাখে। এসময় আমি আমার আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি।

এক পর্যায়ে সুকৌশলে আমার বড় ছেলে আব্দুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার দুরবস্থার কথা জানাই এবং আমাকে এই বন্দিদশা থেকে উদ্ধারের জন্য আইনের আশ্রয় নিতে বলি। পরবর্তীতে ডিবি পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে আমাকে আমার বাবার জিম্মায় দেয়।’

মামুনুল হকের সঙ্গে পরিচয়ের বর্ণনা দিয়ে ঝর্ণা তার এজাহারে বলেন, ‘আমার সাবেক স্বামী শহীদুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে ২০০৫ সালে মামুনুলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। মামুনুল হকের সঙ্গে পরিচয়ের আগে আমাদের দাম্পত্য জীবন অত্যন্ত সুখে-শান্তিতে অতিবাহিত হচ্ছিল। স্বামীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে আমাদের বাসায় মামুনুল হকের অবাধ যাতায়াত থাকায় পরিচয়ের শুরু থেকেই আমার ওপর তার লোলুপ দৃষ্টি পড়ে।

যার ফলে আমাদের ছোটখাটো সাংসারিক মতানৈক্যের মধ্যে সে সু-কৌশলে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে থাকে। মামুনুল হকের কু-মন্ত্রণায় আমাদের দাম্পত্য জীবন চরম বিষিয়ে ওঠে। সাংসারিক এই টানাপড়েনের মধ্যে মামুনুল হকের পরামর্শে ২০১৮ সালের ১০ আগস্ট বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।’

এজাহারে বলা হয়েছে, ‘বিচ্ছেদের পর আমি পারিবারিক, ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অসহায় হয়ে পড়ি। আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে মামুনুল হক আমাকে সহযোগিতার নাম করে সু-কৌশলে ঢাকায় আসার জন্য আমাকে প্ররোচিত করে। আমি একজন আলেমকে ভরসা করে সরল বিশ্বাসে তার সঙ্গে ঢাকায় চলে আসি।

ঢাকায় আসার পর শুরুতে আমাকে তার পরিচিত বিভিন্ন অনুসারীদের বাসায় আমাকে রাখে এবং নানাভাবে আকার ইঙ্গিতে আমাকে কু-প্রস্তাব দিতে থাকে। একপর্যায়ে আমার পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে তার প্রলোভনে পা দিতে বাধ্য হই। এরই ধারাবাহিকতায় তার পরামর্শে আমি কলাবাগানের নর্থ সার্কুলার রোডের একটি বাসায় সাবলেট ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করি এবং তার ঠিক করে দেওয়া একটি বিউটি পার্লারে কাজ শিখতে থাকি।’

মোদিবিরোধী আন্দোলনের নামে রাজধানী ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারীতে বেপরোয়া তাণ্ডবের পর রিসোর্টকাণ্ডে মামুনুল হককে নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। গত ৩ এপ্রিল সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টে এক নারীসহ স্থানীয়দের হাতে আটক হন মামুনুল। সেই নারীই ঝর্ণা, যাকে কথিত নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী জানিয়ে মামুনুল বলেছিলেন, তার নাম আমিনা তাইয়্যেবা।

রিসোর্টে মামুনুল যখন বেকায়দায় পড়েন, তখন তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে হেফাজতে ইসলামের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। তারা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে সবাইকে জড়ো করে হামলে পড়ে রিসোর্টে। ব্যাপক ভাঙচুর করে ছিনিয়ে নেয় মামুনুল হককে।

রিসোর্টে স্থানীয় লোকজনের হাতে ঘেরাও হওয়ার পর মামুনুল ঝর্ণাকে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করলেও তার প্রকৃত নাম, শ্বশুরবাড়ি, শ্বশুরের নাম সম্পর্কে যেসব তথ্য দিয়েছেন, তার সঙ্গে সেই নারীর দেয়া তথ্যের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। মামুনুল জানান, তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম আমেনা তইয়্যেবা। বাড়ি খুলনায়, শ্বশুরের নাম জাহিদুল ইসলাম।

মামুনুলের সঙ্গীনি জানান, তার নাম জান্নাত আরা ঝর্ণা, বাবার নাম অলিয়র, গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়। দুইজনের তথ্যের এই গরমিলের মধ্যেই বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোনে কথোপকথনের অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হয়।

এর একটিতে বোঝা যায় মামুনুল তার চার সন্তানের জননী স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, সেই নারী তার পরিচিত শহীদুল ইসলামের স্ত্রী। ঘটনার কারণে চাপে পড়ে তাকে স্ত্রী পরিচয় দিতে বাধ্য হয়েছেন।

পরে আরেকটি কথোপকথন ফাঁস হয়, যা মামুনুলের সঙ্গে তার রিসোর্টের সঙ্গীনির মধ্যকার বলে প্রতীয়মান হয়। সেখানে সেই নারী জানান, তিনি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তার মায়ের একটি বন্ধ মোবাইল নম্বর দিয়েছেন। আর অন্য একজন যখন তাকে কোথায় বিয়ে হয়েছে জিজ্ঞেস করেছে, তখন তিনি বলেছেন, এটা জানেন না। মামুনুলের সঙ্গে কথা বলে নেবেন।

আরও একটি কথোপকথনে বোঝা যায় মামুনুলের বোন কথা বলেছেন হেফাজত নেতার চার সন্তানের জননী স্ত্রীর (আমিনা তাইয়্যেবা) সঙ্গে।

তিনি তাইয়্যেবাকে বুঝিয়েছেন, কেউ যদি তাকে ফোন করে, তাহলে তিনি যেন বলেন, তিনি বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন এবং তার শ্বাশুড়ি এই বিয়ের আয়োজন করেছেন। এরপর মামুনুল ফেসবুক লাইভে এসে বলেন, তিনি বিয়ে করেছেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রীকে। পারিবারিকভাবেই এই বিয়ে হয়েছে।

পরদিন ফেসবুক স্ট্যাটাসে মামুনুল একে একটি ‘মানবিক’ বিয়ে উল্লেখ করে লেখেন, সেই নারীর সঙ্গে তার স্বামীর ছাড়াছাড়ির আগে তিনি সংসার টেকানোর চেষ্টা করেছেন। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর মেয়েটি দুর্দশায় পড়ে যায়। সে সময় তিনি বিয়ে করে নিয়েছেন তাকে।

প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়ে ঝর্ণাকে বিয়ে করার ব্যাখ্যায় ইসলামি শরিয়তের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, ‘ইসলামি শরিয়তের মধ্যেও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে যে, স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য, স্ত্রীকে খুশি করবার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে, সীমিত ক্ষেত্রে সত্যকে গোপন করারও অবকাশ রয়েছে।’

এসব ঘটনার মধ্যেই গত ১৮ এপ্রিল মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাৎক্ষণিকভাবে মোহাম্মদপুর থানায় করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলেও পরে আর অনেক মামলা পাওয়া যায় তার নামে। এসব মামলায় দ্বিতীয় দফায় সাত দিনের রিমান্ডে আছেন মামুনুল।

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ