বিতর্কিত ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পাঁয়তারা!


নিজস্ব প্রতিবেদক ৮ আগস্ট, ২০২২ ২:২৭ : অপরাহ্ণ

রাষ্ট্রায়ত্ব তেল বিপণন প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানী লিমিটেডে এক বিতর্কিত ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার তৎপরতার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। যমুনা অয়েল কোম্পানী লিমিটেড বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান।

অভিযোগ আছে–ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আনসারীর বহুমুখী অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সরকারী মালিকানাধীন এই কোম্পানীর অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এবার দুর্নীতির দায়ে দুদকের মামলায় জেল খাটা ও বিতর্কিত এক কর্মকর্তাকে অবসরের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার তৎপরতা চালানোর নতুনভাবে অভিযোগ উঠেছে এমডি গিয়াস উদ্দিন আনসারীর বিরুদ্ধে।

জানা যায়–কোম্পানীর কর্মকর্তা মাসুদ করিম বর্তমানে জিএম (এইচ আর)-এর দ্বায়িত্ব পালন করছেন। এই দ্বায়িত্বের পাশাপাশি তিনি অতিরিক্ত দ্বায়িত্ব হিসেবে জিএম (ফাইন্যান্স)/ সিএফও এবং ডিজিএম (আইটি)-এর দায়িত্বও পালন করেন। তিনি আগামী ১১ আগষ্ট ২০২২ অবসরে যাওয়ার কথা। তাকে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার জন্য এমডি গিয়াস উদ্দিন আনসারী তৎপরতা চালাচ্ছেন যদিও তার বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকান্ডসহ দুর্নীতির অভিযোগ আছে।

তার বিরুদ্ধে যমুনার এফডিআর ভাঙিয়ে ১৫ কোটি টাকার ক্ষতি সাধন, নিয়োগ বাণিজ্য, বদলী বাণিজ্য ও প্রমোশন বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। জিএম (এইচআর) মাসুদ করিম ২০১৪ সালে দুদকের করা বিটুমিন সংক্রান্ত একটি মামলায় প্রায় দেড় মাস জেল খাটেন। জেল থেকে বের হয়ে পুনরায় চাকুরিতে যোগদান করে আরো বেপরোয়া হয়ে যান।

মাসুদ করিম কিছু অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজসে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে কিছু বেসরকারী ব্যাংককে অবৈধ সুবিধা দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অনৈতিক লাভবান হয়ে ২১০ কোটি ৬৭ লক্ষ ২০ হাজার টাকার এফডির মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙিয়ে কোম্পানী তথা সরকারের ১৫ কোটি ৭ লক্ষ টাকার অধিক ক্ষতি সাধন করেছেন।

ক্ষতির বিষয়টি সুষ্পস্টভাবে উঠে আসে বহিঃনিরীক্ষার দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত অডিট ফার্ম ‘আহমদ জাকির এন্ড কোং’ ও হুদাবাসী চৌধুরীর এন্ড কোং এর প্রতিবেদনে। এই বিষয় নিয়ে পত্রিকায় একাধিক সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।

কিন্তু অদৃশ্য কারনে বিপিসি এই বিষয়ে এখনো কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বরং ম্যানেজ হয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করে দুদক। ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী-এ অভিযোগের বিষয়ে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে যমুনা অয়েলের চার কর্মকর্তাকে দায়মুক্তি দেয় দুদকের সংশ্লিষ্ট অুনসন্ধানকারী কর্মকর্তা। অনুসন্ধানের রিপোর্ট প্রত্যাখান করে বিষয়টি পুনঃতদন্তের জন্য বিবাদীর আবেদন ইতিমধ্যে দুদকে জমা হয়েছে বলে জানা যায়।

২০২০ সালে মাসুদ করিম ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নিয়ম বহির্ভূত প্রমোশন দিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে। তখন একটি এনআরসি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। এনআরসি কমিটিকে পাশ কাটিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে কিছু কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়।

২০২০সালের ২৩ এপ্রিল রাজশাহী রেলওয়ে ডিপো থেকে ৬ হাজার ৯২৫ লিটার তেল পাচারের সময় যমুনা অয়েল কোম্পানীর রাজশাহী ডিপোর ইনচার্জ আমজাদ হোসেনসহ তিনজনকে হাতেনাতে আটক করেছিল রেলওয়ে পুলিশ। বর্তমানে তিনি জেল হাজতে আছেন।

তেল চুরির মুল হোতা আমজাদ হোসেন ইতিপূর্বেও কোম্পানীর চিলমারী ডিপোর ইনচার্জ হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করার সময়ে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে ২০ লাখ টাকার এই তেল পাচার করেন । বিষয়টি অডিট এবং তদন্তে ধরা পরে। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে আরো বড় দ্বায়িত্ব দিয়ে রাজশাহী ডিপোর ইনচার্জ হিসেবে বদলী করা হয়।

বদলীর ক্ষেত্রেও জিএম (এইচআর) মাসুদ করিম এবং এমডি গিয়াস উদ্দিন আনসারী নিয়ম-কানুন মানেনি। যেকোন বদলি পদায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চাহিদা ও পরামর্শ বিবেচনায় নেয়া হয়। রীতি ভঙ্গ করে ডিজিএম (এইচ আর) মাসুদ করিম নিজেই প্রস্তাব দেন আবার নিজেই বদলির আদেশ ইস্যু করেন।

এইচআর বিভাগের প্রধান হয়ে অন্য বিভাগের (পরিচালন বিভাগের) একজন কর্মকর্তার বদলির সুপারিশ নিজে করে আবার নিজেই বদলির আদেশ ইস্যু করা একটি মারাত্মক অনিয়ম।

কিছুদিন আগে কোম্পানীর শ্রীমঙ্গল ডিপোর ইনচার্জ জনাব মোঃ বেলায়েত হোসাইন খান, জুরিয়র অফিসার (ডিপো) (সম্প্রতি তিনি অফিসার পদে পদোন্নতি পান) হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরলে অন্য অফিসার দ্বায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তেলের ঘাটতি পান।

এই অফিসার তেলের ঘাটতির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করলেও কোন ব্যবস্থা না নিয়ে পূনরায় বেলায়েতকে শ্রীমঙ্গল ডিপোর ইনচার্জ হিসেবে ১৩ আগষ্ট ২০২০ইং তারিখ পদায়িত করে কর্তৃপক্ষ এবং বেলায়েত এখনো দ্বায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে পুরষ্কার হিসেবে সম্প্রতি তাকে জুনিয়র অফিসার (এম-৮) হতে অফিসার(এম-৭) পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এই সবই মোটা অর্থের বিনিময়ে হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

বিপিসি ও কোম্পানী সূত্রে জানা যায়, বিগত তিন বছর ধরে যমুনা অয়েলের যে সব ডিপোতে লাভ হতো সেই সব ডিপোর লাভ বর্তমানে অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে। এমনকি লাভ হওয়া ডিপোতে বর্তমানে লস হচ্ছে। আবার যে সব ডিপোতে লস হতো সেসব ডিপোতে লসের মাত্রা আরো অধিক হারে বেড়ে গেছে। মূলত যমুনা অয়েলের এইচআর বিভাগের প্রধান হিসেবে মাসুদ করিমের দ্বায়িত্ব গ্রহন এবং এমডি হিসেবে গিয়াস উদ্দিন আনসারী যোগদানের পর হতেই ডিপোগুলোতে লস(ক্ষতি) হতে থাকে।

তাদের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অদক্ষতার কারণে কোম্পানী ও সরকারের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। সাধারণত কোন কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার একমাস আগে অবসরের বিষয়টি উল্লেখ করে কোম্পানী হতে চিঠি (রিমাইন্ড লেটার) দেয়া হয়। সেই অনুযায়ী জিএম(এইচআর) মাসুদ করিমকে ১১ জুলাই চিঠি দেয়ার কথা। কিন্তু তাকে সেই চিঠি দেয়া হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসি ও যমুনা অয়েলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কোম্পানীতে এইচ আর বিভাগসহ অন্যান্য দ্বায়িত্ব নেয়ার মত যথেষ্ট লোক আছে। কোম্পানীতে আগে ডিজিএম দিয়ে এইচআর বিভাগ চালানো হত। মাসুদ করিম নিজেও ডিজিএম (এইআর) হয়ে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি জিএম (এইচআর) হন। কোম্পানীতে এখনো দুই জন ডিজিএম-কে কাজ ছাড়া বসিয়ে রেখে বেতন-ভাতা দিচ্ছেন।

তার হলেন সৈয়দ শহীদূল আলম, ডিজিএম(স্পেশাল এসাইনম্যান্ট) এবং জসিম উদ্দিন, ডিজিএম(প্ল্যানিং এন্ড ইকোনোমিক্স)। এছাড়া আরো কয়েকজন ডিজিএম আছেন এবং তারা জিএম হবারও যোগ্য। এখানে দ্বায়িত্ব নেয়ার মত কর্মকর্তার অভাব পরেনি যে মাসুদ করিমের মত একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হবে। তাছাড়া সরকার সব বিষয়ে ব্যয় সাশ্রয়ী হতে বলেছে। তবুও একটি বিশেষ মহল কেন এবং কার স্বার্থে তাকে এক বছরের জন্য চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে কর্তৃপক্ষ তা বোধগম্য নয়।

এ বিষয়গুলো জানার জন্য যমুনা অয়েল কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দীন আনচারীর সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেনি।

সকালের-সময়/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ