ভুয়া ডাক্তারের ফাঁদে রোগী, নেই প্রশাসনের তদারকি!


২৯ মার্চ, ২০১৯ ২:৫৫ : অপরাহ্ণ

সকালেরসময় রিপোর্ট:: প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভুয়া ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার খবর মিলছে। দেশজুড়ে এই অবস্থা এখন উদ্বেগজনক। চট্টগ্রামে এমন একজন ডাক্তারের সন্ধান মিলেছে। নাম তার ডা: বি-বড়ুয়া (সুরেন)। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশন ও ছাড়পত্র ছাড়া কেউ ডাক্তার লিখে কোন রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার বিধান না থাকলেও এই ভূয়া ডা: বি বড়ুয়া (সুরেন) নিজের নামে প্যাড/ ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে নামের আগে “ডাক্তার” লিখে চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদ পাঠানতলী এলাকায় রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসা সেবা নামে প্রতারণা করে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

ভিজিটিং কার্ডে অনেক বড় বড় ডিগ্রি ও ছবি দিয়ে সে এই কার্ড সবাইকে বিলি ও করে, সে তার ভিজিটিং কার্ডে লিখেছে ডা: বি-বড়ুয়া (সুরেন) এফপিবি, বিআরএমপি, এলএমএফ, বিপিএসএফ, (ঢাকা) মেডিকেল প্রাকটিশনার এন্ড ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানস। চেম্বার-১ এস.এ ড্রাগস্ বংশাল পাড়া, বৌ বাজার, পাঠানতলী, চট্টগ্রাম। চেম্বার-২ সেইফ ল্যান্ড ডায়াগষ্টিক সেন্টার, ২২০৮ মোহসেন মার্কেট ২য় ও ৩য় তলা, কদমতলী নিচের মোড়, চট্টগ্রাম।

প্রশাসনের তদারকি না থাকায় কারণে বি-বড়ুয়া (সুরেন) দীর্ঘদিন প্রতারণা করে আসছে বলে জানান স্থানীয়রা। সুরেনের মত অনেকেই চট্টগ্রাম জুড়ে বিভিন্ন হাট-বাজারে শত শত লাইসেন্সবিহীন নামধারী ডাক্তাররা চেম্বার বসিয়েছেন। আবার অনেকে নিজেই ডাক্তার সেজে ফার্মেসী দিয়ে বসে আছেন। তারা ঔষধ নীতিমালা তোয়াক্ক না করে এবং প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জীবন রক্ষাকারী ঔষধ এলাকার বিভিন্ন রোগীদের কাছে বিক্রি করছেন বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম শহর ও শহরের আশে পাশে গ্রাম গঞ্জে শত শত লাইসেন্সবিহীন নামধারী ডাক্তাররা চেম্বার দিয়ে বসে আছেন। তারা ডিজিটাল ব্যানার ও চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজের নামে কার্ড- প্যাড ছাপিয়ে নামের আগে “ডাক্তার” লিখে বিভিন্ন ডিগ্রি দেখিয়ে এলাকার অশিক্ষিত ও নিরীহ সাদাসিধে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। এলাকার সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে বছরের পর বছর ধরে চিকিৎসা সেবার নামে প্রতারণার ব্যবসা পরিচালনা করে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

বিএমডিসি’র অ্যাক্ট-২০১০ সালে প্রকাশিত গেজেট এর ধারা ২২(১) ও ২৯(১) এর আওতায় বলা আছে ন্যূনতম এমবিবিএস, বিডিএস ডিগ্রীধারী ব্যতীত ও ছাড়পত্র ছাড়া কেউ “ডাক্তার” লিখতে পারবেন না। কিন্তু বি-বড়ুয়া (সুরেন) প্রকৃত ডাক্তার না হলেও এলাকা সাধারণ রোগীদের সাথে প্রতারণা করে আসছেন। বি-বড়ুয়ার নিজ বাড়ী রাঙ্গুনিয়া, সে পাঠানতলী একটি কলোনীতে স্ব-পরিবারে বসবাস করে আসছেন দ্বীর্ঘদিন। সে বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদেরকে তার চেম্বারে ডেকে ঔষধ লিখানো নাম করে এবং তাদের প্রমোশনের লোভ দেখিয়ে ওইসব বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছ থেকে মাসিক মোটা অংকের টাকাও হাতান বলেও জানা যায়।

ডা: বি-বড়ুয়া (সুরেন) রোগীদের যেসব ঔষদ প্রয়োজন হয় তার চেয়ে প্রেসক্রিপশনে অধীক ঔষধ লিখে থাকেন এবং প্রেসক্রিপশনে লেখানো ঔষধগুলো কিনতেও বলেন সেই। আবার যেসব ঔষধ তিনি প্রেসক্রিপশনে লিখে থাকেন তার বেশীর ভাগ স্থানীয় বড় বড় ফার্মেসীতে পাওয়াও যায়না। এর ফলে রোগীদের অতিরিক্ত টাকা, সময় ব্যায় এবং মাত্রা অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক ঔষধ খাওয়ার ফলে রোগ নিরাময়ের চেয়ে রোগীদের শরীরে অনেক সমস্যা হয় বলে জানান ভূক্তভোগিরা।

বিভিন্ন হাট-বাজারে দিন দিন বাড়ছে লাইসেন্স বিহীন ফার্মেসীর সংখ্যা। এগুলোতে দেখা যায় বিভিন্ন ভূয়া ডাক্তাররা এলাকার অবস্থা বুঝে চেম্বার দিয়ে বসে প্রতারণা করেন। তার মধ্য একজন ডা: বি- বড়ুয়া (সুরেন)। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা ফার্মেসীর মালিক ও আবার বনে যান অনেক বড় ডাক্তার। লাইসেন্সবিহীন ওইসব ফামের্সীতে কোনো প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই দেদারছে বিক্রি করছেন দেশের নাম-অজানা নিম্নমানের ঔষধসহ বিদেশি ওষুধও। এলাকার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষেরা সামান্য অসুস্থ হলেই ওইসব ফামের্সী নিকট থেকে নিম্নমানের ঔষধ নিকে খেয়ে আরো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ফার্মেসীর ভূয়া ডাক্তাররা প্রকাশ্যে প্রেসক্রিপশন বা প্রেসক্রিপশন বিহীন ঐসব ওষুধ বিক্রি করে দ্বিগুণ মূল্যও আদায় করছেন। আবার ঐসব ফার্মেসী ব্যবসায়ীরা ডাক্তার হিসেবেও এলাকার বিভিন্ন রোগীদের সেবার নামে করছেন বড় বানিজ্য।

পাঠানতলীর ওয়ার্ডের কয়েকজন ভুক্তভোগী রোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত কয়েক দিন আগে সকালে হঠাৎ করে আমার পেটের ব্যথা হয়েছিল। কোন উপায় না পেয়ে স্থানীয় হাতুড়ে ডাক্তার বি- বড়ুয়া সুরানের কাছে গিয়ে ব্যথার বিষয়ে বললে তিনি তার ফামের্সী থেকে কয়েকটি ঔষধ দিয়ে খেতে বলেন। আমি সেই ঔষধগুলো খাওয়ার ফলে একটু পরে আরও বেশী করে পেটের ব্যথা শুরু হয়। তখন বাধ্য হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে বড় ডাক্তার কাছে গিয়ে আমি ভালো হই। আরেক জন বলেন সে আমার কাছ থেকে একটি ইনজেকশনের দাম রাখত পাঁচ হাজার টাকা, অথচ সেই ইনজেকশনের দাম মাত্র বারশত টাকা।

এ বিষয়ে ডা: বি-বড়ুয়া সুরেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার ব্যাপারে সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন শ্যামল ও হাসান ফেরদৌস জানেন আমি ওদেরকে নিয়ে আপনার সাথে দেখা করব। আমি আর ডাক্তার লিখবো না। আমার হাত অনেক লম্বা এ বিষয়ে নিউজ করলে আপনার অনেক সমস্যা হবে বলে দিলাম।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম জুড়ে বিভিন্ন হাট-বাজারে ভুয়া ডাক্তারদের উপদ্রব বেড়ে গেছে এই কথা সত্য। আর সেইসঙ্গে লাইসেন্সবিহীন ফামের্সী ব্যবসায়ীরা প্রেসক্রিপশন ছাড়া নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করে ক্রেতাদের কাছ থেকে দ্বিগুণ মূল্যে অর্থ আদায় করছেন। এতে করে এলাকার বিভিন্ন রোগীরা প্রতারিত হচ্ছে। আবার একই ফার্মেসীতে মানুষের ঔষধ, ভেটেনারি ঔষধ এবং শিশু খাদ্যও তারা বিক্রি করছেন। এদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান অভিযান পরিচালনা করা হবে।

এ বিষয়ে ডাক্তার শফিউল আযম বলেন, ভূয়া ডাক্তারের খবর আমাদের কাছে দিন দিন আসছে, যৌথ উদ্যোগে আমরা অভিযানে সহযোগিতা করব প্রসাশনকে, লাইসেন্সবিহীন ফামের্সী ও ভূয়া ডাক্তার সনাক্তকরণ কাজ চলছে। শহর ও গ্রামে বিভিন্ন স্থানে রয়েছে এসব প্রতারণা। তিনি আরও বলেন, অনভিজ্ঞ হাতুড়ে ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা নিলে রোগীদের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

ভুল এন্টিবায়োটিকের সেবনের জন্য এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্ট হতে পারে রোগীদের। অনেক রোগী শ্বাশকষ্টের সমস্যায় হলে তারা স্টেরয়েড ব্যবহার করেন। ফলে সেইসব রোগীদের ডায়াবেটিক, হদরোগ ও কিডনী রোগসহ বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। প্রায়ই ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগীরা হাসপাতালে আসার পূর্বে ঔসব হাতুড়ে ডাক্তারদের ঔষধ খেয়ে রোগ জটিল করে আমাদের কাছে আসে।

ন্যূনতম এমবিবিএস, বিডিএস ডিগ্রীধারী ব্যতীত বা বাংলাদেশ মেডিক্যাল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রেজিস্ট্রেশন ও ছাড়পত্র ছাড়া কেউ ডাক্তার পদবী লিখতে বা নিজেকে ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে না। এরপরও কোনো ব্যক্তি নামের আগে ডাক্তার লিখেন বা কোন রোগীকে চিকিৎসা দেন তাহলে তার হবে গুরুতর অপরাধ।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রসাশক মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ভূয়া ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এবং এ বিষয়ে আমরা একটা কমিটিও গঠন করেছি, এই কমিটি অভিযুক্ত ভূয়া ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে জেল জরিমানা করবে।

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ