মিয়া জাহানের হাতে ‘আলাদিনের চেরাগ’ ৭ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ!


মোহাম্মদ ফোরকান ২৫ অক্টোবর, ২০২০ ১২:২১ : পূর্বাহ্ণ

শীর্ষপদ মানেই ‘আলাদিনের চেরাগ’ সেই চেরাগের কেচ্ছা সবারই জানা। বাংলাদেশ রেলওয়েতে শীর্ষপদ বাগানো মানেই কর্মকর্তাদের আলাদিনের চেরাগ পাওয়া! পদ পেয়েই কর্মকর্তারা হয়ে যান ‘টাকার কুমির’। যেন চেরাগে ঘষা দিলেই রাতারাতি পকেটে টাকা আসে। সহজ ফর্মুলায় হওয়া যায় কোটিপটি। বাংলাদেশ রেলওয়েতে এমন কিছু কর্মকর্তা রয়েছেন রেল মানে টাকা, টাকা মানে রেল। এখানে নিয়মকে অনিয়ম করে গড়ে তোলা যায় টাকার পাহাড়।

জানা যায়, অপারেশন ও বাণিজ্যিক বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে মোহাম্মদ মিয়া জাহান প্রাক্তন রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হকের সময়ে (অতিরিক্ত মহাপরিচালক, অপারেশন) পদে পদোন্নতি পান। পদোন্নতি পাওয়ার পর থেকেই মিয়া জাহানের অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, সর্বোপরি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত অসদাচরণের কারণে মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তাকে এই পদ হতে অপসারণ করা হয়েছিল।

কিন্তু! বর্তমান রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন দায়িত্বভার গ্রহণ করার পরপরই মিয়া জাহান পুনরায় (অতিরিক্ত মহাপরিচালক, অপারেশন) পদে পদোন্নতি পান। বিষয়টি নিয়ে রেল দপ্তরে চাপা ক্ষোভ ও আর্থিক লেনদেনের প্রশ্ন উৎঘাটিত হলেও ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি।

রেল মন্ত্রাণালয়ের একাদিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকালের-সময় ডট কমকে বলেন, দ্বিতীয়বার মিয়া জাহান এডিজি (অপারেশন) দায়িত্ব নেওয়ার পর সর্বক্ষেত্রে ধরাকে সরা জ্ঞান করে পথ চলছে। তিনি জোনাল অপারেশন ও বাণিজ্যে বিভাগের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের জিএম বা সিওপিএসদের পাত্তা না দিয়ে নিজের খেয়াল-খুশি মতো নানামুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রেলে হ-য-ব-র-ল অবস্থা সৃষ্টি করেছে।

এ বিষয়ে রেলের অপারেশন/কমার্শিয়াল বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা ‘সকালের-সময় ডট কম’কে জানান, মিয়া জাহান কর্মজীবনে কখনোই দক্ষতার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে কাজ করতে পারেননি। তিনি (ডিসিও, ঢাকা) থাকা অবস্থায় কমলাপুর ও সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের পেনশনের নগদ কয়েক কোটি টাকা লোপাট করার কারণে তখন তদন্ত কমিটি সেসময় মিয়া জাহানকে তিরস্কারও করেছিল।

আর এ দিকে ক্যাটারিং সার্ভিসের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ পন্থায় রেলের ৬ কোটি ৮৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা আত্মসাত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে মিয়া জাহান, এসিসিএম (পশ্চিম) আব্দুল জব্বার ও সিআই মোমিনুল ইসলাম মামুনসহ রেলের এই ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

এই বিষয়ে সঠিক তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য গত বছরের ৫ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন রেলের একজন নিয়মিত যাত্রী নওগাঁ জেলার বদলগাছি থানার পার্বতীপুর গ্রামের জসিম উদ্দিন। তখন তিনি অভিযোগের অনুলিপি দিয়েছেন রেলপথ সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান, রেলপথ মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী, সচিবসহ আরো কয়েকটি দপ্তরে। এতে তাদের সাথে অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজন জড়িত থাকার কথা ও বলা হয়েছে অভিযোগে।

জসিম উদ্দিনের অভিযোগ পত্র থেকে আরও জানা যায়, মোঃ মিয়া জাহান রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) থাকায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে রেলের নিয়ম নীতিকে তোয়াক্কা না করে বনলতা এক্সপ্রেস, বেনাপোল এক্সপ্রেস, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ও কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসকে ব্যবহার করে এসিসিএম (পশ্চিম) আব্দুল জব্বার ও সিআই মোমিনুল ইসলাম মামুনসহ কয়েকজনকে নিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ক্যাটারিং পরিচালনা করে বিভিন্ন স্টেশন থেকে নিম্নমানের খাবার বিক্রি করে রেলওয়ের সুনাম নষ্ট করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, এই ৪টি ট্রেনে মাসে ৫৭ লাখ ১২ হাজার টাকা ক্যাটারিং বিক্রি হয়েছে। সেই হিসাবে বছরে ৬ কোটি ৮৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা মিয়া জাহান, এসিসিএম (পশ্চিম) আব্দুল জব্বার ও সিআই মোমিনুল ইসলাম মামুনসহ রেলের এই ৩ কর্মকর্তা লোপাট করেছে।

রেল দপ্তরের আরও এক কর্মকর্তা জানান, এডিজি (অপারেশন) মিয়া জাহান অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে থাকেন। তাকে টাকা না দিলে তিনি কোনো কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেন না। তাই সহজে কারও পদোন্নতিও হয় না। পদোন্নতি কোনোদিন হবে কিনা সেটাও বলতে পারছি না।

এ বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশ) মিয়া জাহানের মোঠোফোনে বার বার কল দেয়া হলেও তিনি কল রিসিভ না করে এক ক্ষুদে বার্তায় সকালের-সময় ডট কমকে জানান, এটি একটি সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। কোনো ক্যাটারিং ব্যবসা আমি পরিচালনা করিনি। এর জন্য কিছু দায়বদ্ধ ব্যক্তি রয়েছেন। আপনি আমার চেয়ে খুব ভাল জানেন এখানে রেলের কিছু কর্মকর্তা দিন দিন বিদ্রোহ করছে। কিছু ঠিকাদার আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের অভিযোগ মিথ্যা। এই বছর রেলপথ মন্ত্রণালয় আমাকে জাতীয় ইন্টিগ্রিটি সিস্টেম অ্যাওয়ার্ড ২০২০ দিয়েছে। আমি যদি দুর্নীতিগ্রস্থ হই তবে রেল মন্ত্রী কীভাবে আমাকে এনআইএস প্রদান করলেন???

এ বিষয়ে রেল সচিব মোফাজ্জেল হোসেন সকালের-সময় ডট কমকে বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি, আমাকে একজন বলেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে রেলের ক্যাটারিং সার্ভিসে ৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পেয়েছি মিয়া জাহানসহ ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এতে সচিব আরও বলেন, আমি অবশ্যই তদন্ত করে দেখব। সচিব হিসেবে আমার দরজা সবসময় খোলা। যে কোনো সমস্যার সমাধানে আমরা অনড় রয়েছি।

জানা যায়, মিয়া জাহানদের অনিয়ম-দুর্নীতি সহযোগি হিসেবে কাজ করেছেন বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক বড়বাবু খ্যাত মোখলেছুর রহমান। রেলের অপারেশন ও বাণিজ্যিক বিভাগের ব্যর্থতার পিছনে তারও হাত রয়েছে বলে জানা যায়। রেলের সকল অর্জন ও সুনাম বর্তমানে ম্লান হওয়ার পথে। এভাবে চলতে থাকলে রেলওয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে একদিন ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করছেন রেল সংশ্লিষ্টরা।

প্রিয় পাঠক, আগামীপর্বে মিয়া জাহানদের আরও দুর্নীতির তথ্য জানতে ‘সকালের-সময় ডট কম’ এর সাথে থাকুন…

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ