দুর্নীতির আতুড়ঘর ঢাকা ওয়াসা, উধাও ১১০ কোটি টাকা!


নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা ২৫ জুলাই, ২০২২ ৩:১১ : অপরাহ্ণ

ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পে ১১০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ের হিসাব মিলছে না। কোন খাতে কীভাবে খরচ করেছে তার হিসাব দিতে না পারায় ২৬টি ব্যয়ে আপত্তি তুলেছে অডিট বিভাগ। অন্যদিকে ৩ বছরের প্রকল্প ৬ বছরেও শেষ হয়নি। সময় আরও দুবছর বাড়িয়ে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। গত মে পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি মাত্র ২৩ শতাংশ। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করতে না পারায় ভোগান্তি বেড়েছে রাজধানীবাসীর।

সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণে প্রকল্পটির এ চিত্র উঠে এসেছে। সংস্থাটি অডিট আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বলেছে। অন্যদিকে ওয়াসার কর্মকর্তা বলছেন, প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই সব হিসাব দেওয়া হবে।

আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পটির বাহ্যিক অডিট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রকল্পের ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ৫ অর্থবছরে ২৬টি অডিট আপত্তি রয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট অর্থের পরিমাণ ১১০ কোটি ৬৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত কোনো অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি হয়নি। তবে আপত্তিগুলোর জবাব প্রক্রিয়াধীন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৬-১৭ সালে সাতটি অডিট আপত্তিতে রয়েছে ৬৫ কোটি ৫৮ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুটি অডিট আপত্তিতে ১১ কোটি ৬৮ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সাতটি অডিট আপত্তিতে ৩ কোটি ৯ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাঁচটি অডিট আপত্তিতে ১৩ কোটি ৫৩ লাখ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে পাঁচটি অডিট আপত্তিতে ১৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।

প্রকল্পটিতে ১১০ কোটি টাকা অডিট আপত্তির বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলেন, এখনও তো ফাইনাল রিপোর্ট আসেনি। এখনও ড্রাফট ফাইনাল চলছে। ফাইনাল রিপোর্টের সময় এগুলো সার্টিফাই করতে হবে। এটা কোনো মারাত্মক কিছু নয়। এটা প্রসেসের মধ্যেই চলতে থাকে। যখন প্রকল্পের সমাপ্তি প্রতিবেদন (পিসিআর) হবে তার আগে এগুলো সব ঠিক করে রাখতে হবে। তা না হলে তো পিসিআরই হবে না। অসম্পূর্ণ থাকবে।

তিনি বলেন, প্রকল্পের কর্মকর্তারা প্রত্যেকটি অডিট আপত্তিরই জবাব দিয়েছেন। এখন অডিট নিয়ে একটা মিটিং হবে, সেখানে এগুলো রিসলভ হবে। সেখানে না হলে পার্লামেন্টারি কমিটিতে চলে যাবে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, আমরা তো ইতোমধ্যেই লিখে দিয়েছি, ওয়াসার এই প্রকল্পে এই অডিট আপত্তি আছে এবং এত টাকা ইনভল্পমেন্ট আছে। আইএমইডি শুধু বিষয়টি ধরিয়ে দিতে পারে। আমরা তো অবশ্যই রিপোর্টটা স্থানীয় সরকার বিভাগকে দিচ্ছি।

এখন হয় এটা ওয়াসা নিজেই নিষ্পত্তি করবে আর যদি না করে তা হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের বলা আর না হয় ব্যবস্থা নেওয়া। আমাদের প্রত্যাশা হবে এই যে, তারা এই রিপোর্টটার ওপর ভিত্তি করে নিশ্চিতভাবে ওয়াসাকে বলবে তোমরা অডিটটা দ্রুত নিষ্পত্তি করো। প্রকল্প চলমান থাকলেও আমরা চাই পুরনো কোনো অডিট আপত্তি থাকলে সেটা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়।

বিষয়টি নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, খরচ হয়েছে কিন্তু বিল দেয়নি এটা তো হতে পারে না। বিল ছাড়া খরচ হবে কেমন করে। প্রকল্পে কোন ক্ষেত্রে কত টাকা ব্যয় হয়েছে সেটার দালিলিক তথ্য থাকতে হবে। সেটা যদি না থাকে তা হলে এখানে অনিয়ম হয়েছে, সেটা ধরেই নিতে হবে। সেটার জন্য অবশ্যই ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

তিনি বলেন, যেহেতু অডিটে একটা প্রকল্পে এত বিশাল অর্থের ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে আইএমইডির প্রতিবেদনে। তারা যেভাবে উত্তর দেবে বলে বলা হচ্ছে। এটা তো তারা করতে পারে না। এটা সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দুর্ভাগ্যবশত ওয়াসা এত নির্বিকারভাবে অনিয়ম করে যাচ্ছে, যেটা কারও যেন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। কী কারণে সেটা হচ্ছে তা দেশবাসীর জানা উচিত।

প্রকল্পের সার্বিক তথ্য থেকে জানা গেছে, নগরায়ণের কারণে ঢাকা শহরে নগরবাসীর নির্ভরযোগ্য পানি সরবরাহ চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে ঢাকা ওয়াসার সেবার মান ও সক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি হয়ে পড়েছে। এজন্য অধিক ঘনত্বের পলিইথিলিন পাইপ এবং ট্রেন্সলেস টেকনোলজি ব্যবহার করে ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক সুবিধা উন্নয়নসহ স্মার্ট মিটার স্থাপনে ৩ হাজার ১৮২ কোটি ৩০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প ২০১৬ সালের মে মাসে অনুমোদন দেওয়া হয়।

ঢাকা ওয়াসার এই প্রকল্প ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা, কিন্তু কাজে ধীরগতি এবং বাস্তবায়নে প্রত্যাশিত অগ্রগতি না থাকার কারণে প্রকল্পের খরচ ও মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। খরচ ৬০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পায়। আর মেয়াদ দুবছর বাড়িয়ে পৌনে আট বছরে নেওয়া হয়। চলতি ২০২২ সালের মে পর্যন্ত ৬ বছরে কাজের অগ্রগতি মাত্র সাড়ে ২৩ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ এখন ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

প্রকল্পে দুর্বলতার মধ্যে রয়েছে- প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইকালে প্রত্যাশী সংস্থা হিসেবে ঢাকা ওয়াসা সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতামত না নেওয়ার ফলে প্রকল্পে খনন কাজে অনুমতি পেতে বিলম্ব হয়। খনন কাজে সিটি করপোরেশন অতিরিক্ত চার্জ নির্ধারণ করায় এবং ঠিকাদার কর্তৃক সময়মতো কাজ সম্পন্ন করতে বিলম্বের ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি হয়।

প্রকল্পের সাত অর্থবছর অতিক্রম হওয়ার পরও দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ঢাকা ওয়াসার খনন কাজ নিয়ে এখনও কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা হয়নি। ফলে প্রকল্পটি ঝুঁকির কারণ হতে পারে বলে আইএমইডি মনে করছে।

প্রকল্পটির বিষয়ে আইএমইডির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, সমন্বয়হীনতার কারণেই প্রকল্প সঠিক সময়ে শেষ করা যায় না। খরচ বৃদ্ধি পায়। প্রকল্পে ১৬০০ কিলোমিটার পাইপলাইন পুনঃস্থাপনের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৮২৫ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। দুটি প্যাকেজের ঠিকাদারের পারফরম্যান্স অবনতির কারণে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।

তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করতে হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। এখন পর্যন্ত ২৬টি অডিট আপত্তি রয়েছে। তার সঙ্গে ১১০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা জড়িত। এই আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। আগামীতে এ ধরনের প্রকল্প নিতে হলে ঢাকা ওয়াসাকে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় মতামত নিতে হবে বলে তারা মন্তব্য করেন।

প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো হলো- এনআরডব্লিউ কমানোর জন্য বিতরণ নেটওয়ার্কের সংস্কার করা, পুনর্বাসন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ, ওয়াটার মিটারসহ সংযোগ দেওয়া, ক্লোরিনেশন ইক্যুইপমেন্ট, স্ক্যাডা সরবরাহ ও স্থাপন, এএমআর সরবরাহ ও স্থাপন, ৩৩টি বাইক ও আটটি গাড়ি কেনা, যন্ত্রপাতি কেনা, পরামর্শক সেবা, পুনর্বাসনের জন্য এনজিও সেবা, চাহিদা ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা প্রচারের জন্য এনজিও সেবাগ্রহণ।

সূত্র–এসএ/এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ