হরিলুটে চলছে জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল!


নিজস্ব প্রতিবেদক ২২ অক্টোবর, ২০২৩ ১:২৩ : অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালে অনিয়ম-দুর্নীতির যেন শেষ নেই! নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, নিয়োগ কমিটি ও কার্যনির্বাহী কমিটির অনুমোদন ছাড়াই গত ১০ বছরে এখানে অন্তত ৫৩ জন ডাক্তার, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন হাসপাতাল পরিচালনাকারী ডা. শেখ শফিউল আজমের মেয়ে, ভাতিজা, গৃহকর্মীসহ ৮ স্বজন। প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় উঠে এসেছে এ তথ্য।

জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালটি চট্টগ্রাম জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির একটি প্রতিষ্ঠান। জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে এই হাসপাতালের সবকিছু দেখাশোনা করেন। তবে ২০০৯ সাল থেকে গত ২ জানুয়ারি পর্যন্ত হাসপাতালটির সবকিছু তদারকি করেন সোসাইটির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ডা. শেখ শফিউল আজম। সোসাইটির নতুন কমিটি দায়িত্ব নেয় গত ৩ জানুয়ারি। ওই দিন থেকে জেমিসন হাসপাতাল তদারকির দায়িত্বেও পরিবর্তন আসে।

নতুন কমিটির সাম্প্রতিক তদন্তে ২৩ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ব্যক্তিগত ফাইলে জাল সনদ, বয়স কমিয়ে দেখানোসহ নানা অসামঞ্জস্যতা ধরা পড়ে। শুধু তাই নয়, বছরের পর বছর কাজ না করে বেতন তোলার ঘটনাও প্রকাশ্যে এসেছে। অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষার তথ্য বলছে, ডাক্তার ও কর্মচারী নিয়োগে যোগ্যতার বিষয়টি একদমই গুরুত্ব পায়নি। সোসাইটির নিয়োগ প্রক্রিয়াও অনুসরণ হয়নি।

সোসাইটির নিয়োগ প্রক্রিয়া হলো, কোথাও লোকবল প্রয়োজন হলে প্রথমে ওই বিভাগ থেকে (যেমন– গাইনি, শিশু, প্যাথলজি) চাহিদাপত্র সেক্রেটারির কাছে উপস্থাপন করা হবে। সেক্রেটারি তা যাচাই-বাছাই করে যৌক্তিক মনে করলে সোসাইটির নির্বাহী কমিটির সভায় উপস্থাপন করবেন। ওই সভায় আলোচনার মাধ্যমে তা পাস হলে পদের সংখ্যা উল্লেখ করে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে।

এর পর নিয়োগ কমিটি গঠন করে নিয়োগ পরীক্ষা ও ভাইভা শেষে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জনকারীকে নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু এই নিয়মের তোয়াক্কা না করে গত ১০ বছর ডা. শেখ শফিউল আজম বিভিন্ন পদে সরাসরি লোক নিয়োগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন যা ক্ষমতার অপব্যবহার।

গত ৯ আগস্ট সোসাইটির বর্তমান চেয়ারম্যান এ টি এম পেয়ারুল ইসলামের কাছে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি জমা হয়। হাসপাতালের বর্তমান পরিচালনা কর্তৃপক্ষ বলছে, বিধি ও প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে লোক নিয়োগের নেপথ্যে রয়েছে মোটা অঙ্কের লেনদেন।

এ বিষয়ে ডা. শেখ শফিউল আজম বলেন, আমার কয়েকজন আত্মীয় নিয়োগ পেয়েছে, এটা সত্য, তবে তা নিয়ম মেনেই হয়েছে। কোনো অনিয়ম হয়নি। টাকা নিয়ে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট।

চট্টগ্রাম জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নতুন চেয়ারম্যান এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, গত এক যুগ এই হাসপাতালে জনবল নিয়োগে কোনো নীতিমালা মানা হয়নি। অবৈধভাবে একের পর এক নিয়োগে হয়েছে। ফলে অন্তত ৩০ জন কর্মী এখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত।

স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা চলছে বলে কাছে মন্তব্য করেছেন সোসাইটির নতুন সাধারণ সম্পাদক আসলাম খান। তিনি বলেন, হাসপাতাল পরিচালনাকারী সাবেক এক ব্যক্তি তাঁর মেয়েসহ আট স্বজনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। এভাবে নিয়োগ পাওয়া ২৩ জনকে শোকজ করা হয়েছে।

ডা. শফিউল আজমের আট স্বজন কারা!

অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল পরিচালনাকালে ডা. শফিউল আজম সোসাইটির নিয়োগবিধি অমান্য করে তাঁর মেয়ে শেখ সানজানা শামরিন মিমকে মেডিকেল অফিসার পদে নিয়োগ দেন। এ ছাড়া তাঁর ভাগিনা মো. আলাউদ্দিনকে সিনিয়র প্যাথলজি টেকনিশিয়ান, ভাতিজা অহিদুল ইসলাম রনিকে প্যাথলজি টেকনেশিয়ান ও রাকিবুল আলমকে লিফটম্যান, আত্মীয় এ এস এম গনিউল নুরকে চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, গৃহকর্মী জয়নাব বেগম ও তাঁর ছেলে মামনুর রশিদকে পিয়ন এবং চাচাতো ভাই মমিনুল হককে প্লাম্বার পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এসব নিয়োগে যোগ্যতা যাচাই হয়নি বলে নিরীক্ষা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

মূল্যায়ন কমিটির তদন্তে ধরা ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী

২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত হাসপাতালে সরাসরি নিয়োগ পাওয়া ৫৩ জন ডাক্তার, কর্মকর্তা, কর্মচারীর একাডেমিক ও দক্ষতা সনদ যাচাই-বাছাইয়ে ‘স্টাফ সার্ভিস বুক মূল্যায়ন কমিটি’ গঠন হয় ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর। কমিটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিল করে গত ১৮ মার্চ।

প্রতিবেদনে ২৩ কর্মকর্তা ও টেকনিশিয়ানের জমা দেওয়া নথিপত্রে অসামঞ্জস্যতার কথা উল্লেখ করা হয়। গত ৩ অক্টোবর ওই ২৩ জনকে শোকজ করা হয়। তারা এরই মধ্যে শোকজের জবাব দিয়েছেন। এখন ওইসব জবাব যাচাই-বাছাই চলছে।

মূল্যায়ন কমিটি বলেছে, ওই ২৩ জন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি জেমিসন হাসপাতালে চাকরি পেয়েছেন। এদিকে ২৩ জনের মধ্যে ১৩ জনের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট স্থগিত এবং একজনের বেতন বন্ধ করেছে হাসপাতালটির বর্তমান পরিচালনা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া একজনের নিয়োগ বাতিল ও চারজনের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ যাচাই করা হচ্ছে।

অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হলেন

স্টোরকিপার আবুল কাসেম, চিফ টেকনিশিয়ান মো. আলাউদ্দিন, আবুল হোসেন, বেলাল হোসেন, মাসুদ মাহমুদ, রাকিবুল আলম, অপু বড়ুয়া, মবিনুল হক, অহিদুল আলম, নুরুল আবসার, জয়নাব বেগম, মো. শাকিল, আবদুস সবুর, আবদুল মবিন, মামনুর রশিদ, এম এ জাফর, আরশাদ মোনেম খান, সিরাজ উদ্দিন, মফিজুর রহমান রানা, আলমগীর হোসেন, রাজীব কুমার দে, চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট এস এম গনিউল নুর ও ইউসুফ আলী। এ বিষয়ে চিফ টেকনিশিয়ান মো. আলাউদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘জাল সনদে চাকরি নিয়েছি বলে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমাকে শোকজ করেছে। আমি জবাব দিয়েছি।

কাজ না করে বেতন নেন টেকনিশিয়ান

২০১১ সালে ৭ লাখ টাকায় কেনা একটি এক্স-রে মেশিন চালানোর জন্য ওই বছরের ৫ জুলাই নুরুল আবসারকে টেকনিশিয়ান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু মেশিনটি কেনার পর থেকেই অকেজো। এক দিনও চলেনি। ফলে নুরুল আবসারের কোনো কাজ ছিল না। অথচ মাস শেষে তাঁকে ২১ হাজার ৯২ টাকা বেতন দেওয়া হয়েছে। এভাবে ১১ বছরে ২৫ লাখ টাকা বেতন দেওয়ার পর গত ১ সেপ্টেম্বর তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে নুরুল আবসার বলেন, শফিউল আজম স্যার আমাকে নিয়োগ দেন। কিন্তু যোগদানের পর থেকে এক্স-রে মেশিনটি নষ্ট থাকায় আমাকে অন্য কাজ দিয়েছিলেন। নতুন কমিটি আমাকে চাকরিচ্যুত করেছে।

অতিরিক্ত জনবলে বেড়েছে ব্যয়

২০০৯ সালে ডা. শফিউল আজম জেমিসন হাসপাতালের দায়িত্ব পাওয়ার সময় সেখানে জনবল ছিল ১৫৭ জন। ১০০ শয্যার বিশেষায়িত এ হাসপাতালে এখন জনবল ১৯৭। তার মধ্যে প্রায় ৩০ জন প্রয়োজনের অতিরিক্ত মনে করেন সোসাইটির বর্তমান চেয়ারম্যান এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত লোক নিয়োগ দিয়ে শুধু শুধু হাসপাতালের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।

সূত্র—এসকে/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ