সরকারি মাল—দরিয়ামে ঢাল!


সকালের-সময় রিপোর্ট  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১২:৩৪ : অপরাহ্ণ

আইন-কানুনের তোয়াক্কা নেই। নিয়ম-নীতির বালাই ষাট! যে যেভাবে পারছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটেপুটে খাচ্ছে। আর নষ্ট করছে।—এ যেন এক মগের মুল্লুক!

চট্টগ্রাম নগরের ধুলোবালি পরিস্কারে অকার্যকর হওয়ায় ছয়টি সুইপিং গাড়ি পড়ে আছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ভাগাড়ে। এসব গাড়ি বিভিন্ন সময় সাত কোটি টাকায় কেনা হয়েছিল। আগের গাড়ি কাজে না এলেও আট কোটি টাকায় নতুন করে আরও দুটি গাড়ি কেনার প্রস্তাব দিয়েছে সিটি করপোরেশনের যান্ত্রিক বিভাগ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোড সুইপিং গাড়িগুলো বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কতটুকু কার্যকর তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কেনায় কোনো কাজে আসেনি। নতুন করে আবারও একই ধরনের গাড়ি কেনা হলে অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু হবে না।

গত মাসে ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে আধুনিক যান-যন্ত্রপাতি সংগ্রহ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রকল্পটির আওতায় ৪১০টি যান-যন্ত্রপাতি কেনায় ব্যয় ধরা হয় ৩৯৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে আট কোটি টাকায় দুটি রোড সুইপিং গাড়ি কেনার প্রস্তাব করা হয়।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) সুদীপ বসাকের দাবি, যে দুটি গাড়ি কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এগুলো অত্যাধুনিক। ঢাকার সিটি করপোরেশনগুলো এসব গাড়ি ব্যবহার করছে। সড়কের ধুলোবালি পরিস্কারে গাড়িগুলো বেশ কার্যকর।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন—মানুষকে চমক দেখানোর জন্য প্রথম রোড সুইপিং গাড়ি কিনেছিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন। তাদের দেখাদেখি অন্যরাও কিনেছে। বাস্তবে গাড়িগুলো কোনো কাজে আসেনি। আমাদের দেশের শহরগুলোর রাস্তায় যে পরিমাণ ধুলোবালি জমে তা পরিস্কারের সক্ষমতা গাড়িগুলোর নেই।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, গত বছর ২৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকায় ২০টি রোড সুইপিং গাড়ি কেনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। প্রতিটি গাড়ির দাম পড়েছে এক কোটি ৪৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে তিনটি গাড়ি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়।

২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর গাড়িগুলোর উদ্বোধন করেন তৎকালীন সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। গাড়িগুলো চালুর পর থেকে সব মিলিয়ে ২০ থেকে ২৫ দিন চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের চালকেরা। প্রায় চার মাস ধরে গাড়িগুলো চালানো হচ্ছে না জানিয়েছে।

চসিকের একাধিক চালক জানান—নগরের সড়কগুলোতে ধুলোর ভারী আবরণ পড়ে থাকে। গাড়িগুলো দিয়ে এগুলো পরিষ্কার করা যায় না। এগুলো দিয়ে ধুলোর হালকা আস্তরণ পরিষ্কার হয়। গাড়িগুলো চালানোর সময় পুরো এলাকা ধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অনেক সময় লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরী বলেন—নগরের সড়কের ধুলোবালি পরিস্কারে প্রতিদিন গাড়িগুলো চালাতে মেয়রের নির্দেশনা থাকলেও এগুলো চালানো হয় না। সম্প্রতি গাড়িগুলো চালাতে দেখা যায়নি। কেন চালানো হচ্ছে না, এটি যান্ত্রিক বিভাগ ভালো বলতে পারবে। তবে যান্ত্রিক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুদীপ বসাকের দাবি, সপ্তাহে দুই দিন গাড়িগুলো নগরের সড়কে চালানো হয়।

এছাড়া ২০১৩ সালের ৮ জুন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সড়কের ধুলোবালি পরিস্কারের জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে দুটি সুইপিং গাড়ি দেয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়। প্রতিটি গাড়ির দাম ছিল ৮৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে ৫০ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে একটি সুইপিং গাড়ি কেনে সিটি করপোরেশন।

গাড়িগুলো সড়কের ধুলোবালি পরিস্কারে কিছুদিন ব্যবহার করে সিটি করপোরেশন। এরপর থেকে নগরের সাগরিকায় সিটি করপোরেশনের ভাগাড়ে গাড়িগুলো ফেলে রাখা হয়েছে। ব্যবহার না হওয়ায় তিনটি গাড়ি নষ্ট হয়ে পড়েছে।

গাড়িগুলো প্রসঙ্গে তৎকালীন সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন—গাড়িগুলো আমাদের দেশের ধুলোবালি পরিস্কারের উপযোগী নয়। গাড়িগুলো মসৃণ পিচঢালা সড়কের হালকা ধুলোবালি পরিস্কার উপযোগী। আমাদের সড়ক ও ফুটপাতে যেভাবে ধুলোবালির ভারী আবরণ পড়ে থাকে গাড়িগুলো দিয়ে এসব পরিস্কার সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. সানাউল রাব্বী বলেন—উন্নত বিশ্বের শহরগুলোতে শতভাগ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়। যে কারণে প্রাকৃতিকভাবে হালকা ধুলোবালি উৎপন্ন হয়। রোড সুইপিং গাড়িগুলো সে সব শহরের জন্য উপযোগী। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে গাড়িগুলো কোনো কাজে আসবে না।

কারণ—এখানে বছরজুড়ে উন্নয়ন কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়। সড়কে ধুলোবালির ভারী আস্তরণ জমে। বৃষ্টিতেও বালু জমে থাকে। এসব গাড়ি দিয়ে তা পরিস্কার করা সম্ভব নয়।

সূত্র—এসকে/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ