মেয়াদোত্তীর্ণ বিদেশি গুঁড়ো দুধে সৈয়দ নূরের প্রতারণা, বাজার সয়লাব!


সকালের-সময় রিপোর্ট  ১২ মে, ২০২১ ৫:০৪ : অপরাহ্ণ

দুধ আবার বানায় কীভাবে? সব সম্ভবের এই বাংলাদেশে দুধ তৈরির কর্মটি গাভী না পুষেও সম্ভব! তাহলে টিভিতে যে খাঁটি দুধের বিজ্ঞাপন দেখি? ওইসব বিজ্ঞাপনের সুন্দর মুখগুলোর সুন্দর হাসির আড়ালে কি তবে শুধুই ধোঁকাবাজি? প্রকৃতপক্ষে আমরা ভেজাল দুধ-ই কিনে খাচ্ছি!

দেশে দুধের ঘাটতি থাকায় গুঁড়ো দুধ আমদানি বাড়ছেই। সেইসঙ্গে আসছে নিম্নমানের গুঁড়ো দুধও। এদিকে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় গুঁড়াে দুধ থেকে কিছু দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানি পাস্তুরিত তরল দুধ তৈরি করছে। তৈরিকৃত এ দুধ আসল দুধের সঙ্গে মিলিয়ে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে এদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খামারিরা অন্যদিকে প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বছর রমজানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন তরল দুধ ও পাউডার দুধের চাহিদা বেশি থাকে, মূলত তখনই অধিক মুনাফার আশায় গুঁড়ো দুধ থেকে তরল দুধ তৈরি করে কিছু অসাধু কোম্পানি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) চট্টগ্রামের পরিচালক বলেন, কোন কোম্পানি যদি তরল দুধ তৈরিতে আমদানিকৃত গুঁড়াে দুধ ব্যবহার করে তবে তা অবৈধ। কারণ গুঁড়াে দুধ থেকে আবার তরল দুধ তৈরি করলে গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।

যার কারণেই দুধের চাহিদাকে পুঁজি করে তৈরি হচ্ছে নকল দুধ। দুগ্ধভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম খাতুনগঞ্জে একটি চক্র এই নকল দুধ তৈরি করছে। এই দুধ তারা বিভিন্ন দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করছে। এরসঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ছানার পানিই নকল দুধ তৈরির প্রধান উপকরণ। আর এই ছানার পানির সঙ্গে ক্ষতিকর স্কিম মিল্ক পাউডার, ফরমালিন, কাটার অয়েল, সোডা ও দুধের ননীর সঙ্গে দুধের কৃত্রিম সুগন্ধি মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করা হয়। পরে আসল দুধের সঙ্গে নকল দুধ মিশিয়ে বিভিন্ন নামি-দামি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানে তা সরবরাহ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুধের ঘনত্ব নির্ণয়ে ল্যাকটোমিটার ব্যবহার করে ভেজাল শনাক্ত করা যায়। কিন্তু এ অসাধু চক্র ভেজাল দুধে ফরমালিনসহ স্কিম মিল্ক পাউডার ব্যবহার করে। এতে দুধের ঘনত্ব বেড়ে যায়, দুধ তাজা থাকে। ফলে ভেজাল বিরোধী অভিযানে ল্যাকটো-মিটার দিয়ে এই সূক্ষ্ম প্রতারণা ধরা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না।

এতদিন জানতাম দুধে পানি মেশানো হয়। কিন্তু এবার জানা গেল, দুধ থেকে যন্ত্র দিয়ে ছানা বের করে নেওয়ার পর, পড়ে থাকা পানিতে মেশানো হচ্ছে কস্টিক সোডা, ইথাইল অ্যালকোহল, হাইড্রোজেন ও পারঅক্সাইডসহ সামান্য গুঁড়ো দুধ।

এভাবে মানুষের জীবন নীরবে ধ্বংস করা হচ্ছে। কে দেবে জনগণের স্বাস্থ্যরক্ষার নিশ্চয়তা? তাহলে খাব কি আমরা? বাঁচব কীভাবে আমরা? যা-ই খাই, তা-ই যদি হয় বিষাক্ত? অথচ, অতি প্রয়োজনীয় ও শিশুদের পছন্দের এই দুধে ভেজালের বেড়াজালে আমরা এমনভাবে আটকে গেছি যে, এখন আসল দুধ চেনাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে এই অপকর্মটি করে আসছে চট্টগ্রাম খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নুর ডেইরি অ্যান্ড ফুডস প্রসেসিং ফ্যাক্টরির মালিকগন। তারা বছরের পর বছর গুঁড়ো দুধের বস্তায় নিজেরাই উৎপাদন ও মেয়াদের সিল মেরে চকচকে মোড়কে বিভিন্ন নামে তরল দুধ ও গুড়ো দুধ বাজারজাত করে আসছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাতুনগঞ্জের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে গুঁড়ো দুধ আমদানি করেন সৈয়দ নূর ও তার ভাইয়েরা, তারা এই দুধ বাজারে খাটি দুধ বলে বিক্রি করে আসছে, অথচ তাদের এইসব দুধ মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল, তারা মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

জানা যায়, যে কোনো রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানেরই দুধের বস্তাগুলোতে সিল মারার কথা। কিন্তু নুর ডেইরি অ্যান্ড ফুডস প্রসেসিংয়ের আমদানি করা দুুুুধের বস্তাগুলোতে মেয়াদের সিল থাকে না। এই প্রতারণা তারা করে আসছেন বছরের পর বছর।

মানবদেরহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের সঙ্গে পানি মিশিয়ে তৈরি করেন তারা ডেইলি তরল দুধ। আবার সরাসরি মেয়াদোত্তীর্ণ গুঁড়ো দুধ চকচকে প্যাকেটে হয়ে যায় মিল্ক কিং পাউডার, নূর মিক্সড পাউডার, নকল এই দুধ গরুর খাঁটি দুধ বলে বিক্রি করছেন খুচরা ও পাইকারি বাজারে। বিভিন্ন কোম্পানিতেও সরবরাহ করা হয় তাদের এই ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ দুধ।

দীর্ঘদিন ধরে এসব মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল দুধ প্যাকেটজাত করে বাজারজাত করার দায়ে সম্প্রতি মাঝির ঘাটের একটি গুদাম থেকে নুর ডেইরি অ্যান্ড ফুডস প্রসেসিংয়ের ২৫ কেজি ওজনের ৪ হাজার ৪০০ বস্তা মেয়াদোত্তীর্ণ গুঁড়ো দুধ জব্দ করেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালত।

এ ঘটনায় তখন গোয়েন্দা পুলিশ ও পণ্যের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিএসটিআই) দুটি মামলা করে।
পুলিশের মামলায় মেয়াদোত্তীর্ণ গুঁড়ো দুধ মজুদ ও ভুয়া সিল মারার অভিযোগ আনা হয়েছে। বিএসটিআইয়ের মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে মান পরীক্ষা না করানোর দায়ে।

মামলায় তিন মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নুর ডেইরি অ্যান্ড ফুডস প্রসেসিং ফ্যাক্টরির মালিক নাজিম উদ্দিনকে। এ ছাড়া তাঁকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তাদের বাড়ি পটিয়া উপজেলার লড়িহড়া গ্রামে। পরে এসব মেয়াদোত্তীর্ণ গুঁড়ো দুধ জেলা প্রশাসন ধ্বংস করে।

এ বিষয়ে জানার জন্য নুর ডেইরি অ্যান্ড ফুডস প্রসেসিংয়ের স্বত্বাধিকারি সৈয়দ নূরের সাথে মোঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি উত্তেজিত হয়ে প্রতিবেদককে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন, এবং এ বিষয়ে নিউজ করলে মামলার হুমকিও প্রদান করেন।

জানা যায়, মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের সঙ্গে পানি মিশিয়ে তৈরি করা হয় তাদের তরল দুধ। নকল এই দুধ গরুর খাঁটি দুধ বলে বিক্রি করা হয় খুচরা ও পাইকারি বাজারে। তরল দুধ বাজারজাতকারী বিভিন্ন কোম্পানিতেও সরবরাহ করা হয় এই দুধ।

সকালের-সময়/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ