মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ১৯৬ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি!


সকালের-সময় রিপোর্ট  ৮ জুন, ২০২১ ৫:০৪ : অপরাহ্ণ

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডকে (এমপিএল) ভ্যাটের ১৯৬ কোটি টাকা দিতেই হবে। পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত এই বিপুল পরিমাণ ভ্যাট পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে।

অবশেষে কমিশনারেটের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে এই ভ্যাট পরিশোধে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডকে ভ্যাট পরিশোধে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার সই করা এই দাবিনামা জারি করা হয়। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর ছাইফুল্লাহ-আল-খালেদ সকালের-সময় ডটকমকে বলেন, এ ভ্যাট আমরা নয়, বিপিসি দেবে। বিপিসির বিআইএন নেই। আমাদের বিআইএন দিয়ে বিপিসির আমদানি করা পণ্য আমরা আমদানি করি।

দাবিনামায় বলা হয়, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটনে ২০১৫-১৬ হতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ব্যবসায়িক কার্যক্রম যাচাই করা হয়। একইসঙ্গে ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির দাখিলপত্র (ভ্যাট রিটার্ন) যাচাই করে ভ্যাট কমিশনারেটের কর্মকর্তারা।

যাতে দেখা যায়, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত কোনো রিটার্ন দাখিল করেনি। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত রিটার্ন দাখিল করেছে। তবে রিটার্নের সঙ্গে বিল অব এন্ট্রি, কর চালান, ক্রয় ও বিক্রয় হিসাবের কোনো তথ্য দেয়নি, যা মূল্য সংযোজন কর বিধিমালা, ১৯৯১ এর বিধি-২২ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এছাড়া ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড থেকে তথ্য নেয় ভ্যাট কর্মকর্তারা। যাতে দেখা যায়, ইস্টার্ন রিফাইনারি মেঘনা পেট্রোলিয়ামকে বিটুমিন সরবরাহ করে। কিন্তু মেঘনা পেট্রোলিয়াম বিটুমিন ক্রয়ের কোনো তথ্য রিটার্নে উল্লেখ করেনি। এমনকি ভ্যাট কর্মকর্তাদের এই তথ্য দেয়া হয়নি।

অপরদিকে, প্রতিষ্ঠানের ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত বার্ষিক প্রতিবেদন (সিএ ফার্মের রিপোর্ট) পর্যালোচনা করেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। যাতে দেখা যায়, ওই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি যে কেনাকাটা বা ব্যয় করেছে তার ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট (উৎসে ভ্যাট) ৩৬ কোটি ৫৮ লাখ ৫৩ হাজার ৮৫৬ টাকা। প্রতিষ্ঠানের পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্য আমদানির বিপরীতে ভ্যাট ও উৎসে ভ্যাটসহ মোট অপরিশোধিত ভ্যাট দাঁড়িয়েছে ৩১১ কোটি ৯৯ লাখ ৩১ হাজার ৯৯১ টাকা।

এই ভ্যাট পরিশোধে ২০১৯ সালের ৮ আগস্ট দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট। পরে প্রতিবেদন পুনরায় যাচাই শেষে ভ্যাট পরিশোধে ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট আবারও দাবিনামা জারি করা হয়। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দুই দফায় সময় নিয়ে একই বছরের ১৯ নভেম্বর নোটিসের জবাব দেয়া হয়।

লিখিত জবাবে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কর্তৃক আমদানি করা অকটেন, ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল কোম্পানির বিআইএনের মাধ্যমে শুল্কায়ন করে থাকে। ওই সময়ে তিন কোটি ৪৫ লাখ ৭০ হাজার লিটার অকটেন খালাস করা হয়েছে।

যাতে অপরিশোধিত মূসক ও অগ্রিম ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসক ২৫ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ১৭ টাকা (মূসক ১৮ কোটি ৯৬ লাখ ১৩ হাজার ২০৫ টাকা ও অগ্রিম ব্যবসায়ী মূসক ছয় কোটি ৪০ লাখ ৪৮ হাজার ৮১২ টাকা)। আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম ব্যবসায়ী মূসক ছিল চার শতাংশ, যা ২০১৮ সালের জুলাই থেকে পাঁচ শতাংশ করা হয়।

কিন্তু অতিরিক্ত এক শতাংশ মূসক প্রতিষ্ঠান থেকে হিসাব করা হলেও ভ্যাট অফিস তা উল্লেখ করেনি। অর্থাৎ অতিরিক্ত এক কোটি ৩৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৭ টাকার অগ্রিম ব্যবসায়ী ভ্যাট পরিশোধ করা হয়েছে। এই মূসক বাদ দিয়ে আমদানি পর্যায়ে অকটেনে মূসক হবে প্রায় ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

একইভাবে ডিজেল খালাস হয়েছে ৬৪৪ কোটি ৬৮ লাখ সাত হাজার ৮২৫ লিটার। যার ওপর অপরিশোধিত মূসক ও অগ্রিম ব্যবসায়ী মূসক চার হাজার ৭৩৯ কোটি ৫৪ লাখ ৬৫ হাজার ৭৪০ টাকা। তবে ২০১৯ সালের জুন থেকে অগ্রিম ব্যবসায়ী মূসকের পরিবর্তে অগ্রিম কর চালু করা হয়। ওই সময় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মূসক, অগ্রিম কর ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসক হিসেবে চার হাজার ৭৪৪ কোটি ৭৪ লাখ ২৬ হাজার ৪১২ টাকা পরিশোধ করা হয়।

অর্থাৎ অতিরিক্ত পাঁচ কোটি ১৯ লাখ ৬০ হাজার ৬৭২ টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু দাবিনামায় অতিরিক্ত জমা করা ভ্যাট বাদ দেয়া হয়নি। এক হাজার ১৬৮ কোটি ৪৩ লাখ ৮৭ হাজার ৫৯৬ টাকা থেকে অতিরিক্ত পরিশোধ করা এই ভ্যাট বাদ দিলে দাবি করা ভ্যাট দাঁড়ায় এক হাজার ১৬৩ কোটি ২৪ লাখ ২৬ হাজার ৯২৪ টাকা।

একইভাবে ফার্নেস অয়েলের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত ১৪ কোটি ৬৪ লাখ ৮০ হাজার ৪৯০ টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করেছে। ফলে ফার্নেস অয়েলের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিশোধ করা ভ্যাট বাদ দিলে বাকি থাকবে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ১৪ হাজার ৬১৯ টাকা। লুব্রিকেটিং অয়েল, গ্রিজ ও ব্রেক ফ্লুইডের ক্ষেত্রে চার বছরে ১৮ কোটি ২০ লাখ ৮০ হাজার ৯৪৫ টাকা অতিরিক্ত ভ্যাট পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে চার বছরে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের আমদানি করা পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্যের ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৯৫ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার ২৮৯ টাকা। যার মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ১১৬ কোটি ২৭ লাখ ৭৯ হাজার ৭৬৪ টাকা পরিশোধ করেনি।

অপরদিকে, প্রতিষ্ঠান দাবি করে। চার বছরে প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য বা সেবা ক্রয়ের বিপরীতে উৎসে ভ্যাট হিসেবে ৫১ কোটি ২৮ লাখ ১৫ হাজার ২৩৮ টাকা দাবি করা হয়েছে। যার মধ্যে প্রতিষ্ঠান ১৪ কোটি ৬৯ লাখ ৬১ হাজার ৩৮২ টাকা পরিশোধ করেছে বলে দাবি করেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। তবে প্রতিষ্ঠানের দাবি, ওই চার বছরে তারা উৎসে ভ্যাট হিসেবে ৩৮ কোটি ৭৩ লাখ ৫৬ হাজার ৫০৭ টাকা পরিশোধ করেছে।

সূত্রমতে, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের জবাব ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের উদ্ঘাটন যাচাই করার জন্য টিম গঠন করা হয়। ওই টিম সব যাচাই শেষে চার বছরে প্রতিষ্ঠানটির ২৪৮ কোটি ৮৮ লাখ ৬৯ হাজার ৮৯০ টাকার ভ্যাট ফাঁকি বা অপরিশোধিত বলে প্রতিবেদন দেয়। এতেও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়। পরে তৃতীয় পর্যায়ে যাচাই করতে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি যাচাই শেষে প্রতিবেদন দেয়।

যাতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬ কোটি ৩৩ লাখ ১৩ হাজার ৪৪৮ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেনি। কমিশনার কমিটির প্রতিবেদন ও সব কিছু পর্যালোচনা করে দেখতে পায়, প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬ কোটি ৩৩ লাখ ১৩ হাজার ৪৪৮ টাকা পরিশোধ করেনি। এই ভ্যাট পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে ১৫ দিনের সময় দিয়ে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়।

উল্লেখ্য, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। ডাইরেক্ট লিস্টিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোম্পানিটির ৩০ শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ২০ লাখ শেয়ার অফলোডকরণের জন্য ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড এবং ২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডে নিবন্ধিত হয়। ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি একযোগে উভয় শেয়ার মার্কেটে কোম্পানির শেয়ার অফলোড শুরু হয়।

সকালের-সময়/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ