নির্বাচনী হাওয়া

বিএনপি–আওয়ামীলীগের একাধিক প্রার্থীতে সরগরম মিরসরাই


নিজস্ব প্রতিবেদক ১৬ অক্টোবর, ২০২৩ ১২:৫০ : অপরাহ্ণ

আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ আসন চট্টগ্রাম-১ মিরসরাই। পূর্বে পাহাড় আর পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা জনপদ মিরসরাই। প্রকৃতির নিদারুণ বুনো ঝরনা আর পাহাড়ি ঝিরিপথের এ অঞ্চলে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর হচ্ছে। এটি মিরসরাইয়ের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। কারণ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মূল প্রভাব বহন করছে মিরসরাই। ১৬টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভা নিয়ে মিরসরাই উপজেলা তথা চট্টগ্রাম-১ সংসদীয় আসন গঠিত হয়েছে।

জনসমর্থনের দিক দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখানে সমানে-সমান। অতীতের প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে এই আসনে অল্প ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনেও যে দল নির্বাচনের মাঠে শক্তি-সামর্থ্য আর কৌশলের রসায়ন ঘটাতে পারবে ভোটের পাল্লা তাদেরই ভারী হবে।

আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এ আসনের এমপি। একটানা ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্তিশালী। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় কোন্দলও দৃশ্যমান। এলাকায় বিক্ষুব্ধ কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।

অপরদিকে, বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়তা। দলটিকে হারানো আসন পুনরুদ্ধার করতে হলে সংগঠন গোছানোর পাশাপাশি জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে হবে, এমনটাই মনে করছেন দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।

অতীত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ১ লাখ ৫ হাজার ৩৩৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির প্রফেসর এমডিএম কামাল উদ্দিন চৌধুরী। তিনি পেয়েছিলেন ৯৪ হাজার ৬৬৫ ভোট।

পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী নুরুল আমিনকে হারিয়ে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি নির্বাচিত হন। তবে এ আসনে অতীতের নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের ব্যবধান ছিল খুব অল্প।

স্বাধীনতার আগে এবং পরে সাতবারের এমপি আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এবং সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে ঘিরে মিরসরাইয়ের আওয়ামী রাজনীতি আবর্তিত। তবে এ আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন। ৮০ বছর বয়েসি আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আগামীতে আর নির্বাচন করবেন না বলে সরাসরি ঘোষণা দিয়েছেন। তবে বিকল্প হিসেবে তিনি তারই মেজ ছেলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আইটি বিশেষজ্ঞ মাহবুবুর রহমান রুহেলকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।

মোশাররফ পুত্র মাহবুবুর রহমান রুহেল ১৯৯৭ সালে সপরিবারে ফিনল্যান্ড থাকাকালীন সময় দেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাতকে অগ্রসর করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শ ও অর্থায়নে তার জ্যেষ্ঠ সন্তান সজিব ওয়াজেদ জয়সহ ঢাকার পান্থপথ এলাকায় বেইজ লিমিটেড নামের একটি কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার খোলেন। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে ফিনল্যান্ড ছেড়ে তিনি সপরিবারে দেশে ফিরে এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় আইটি কোম্পানি লিনেক্স ও ওরাকলকে দেশের প্রযুক্তিখাত উন্নয়নে যুক্ত করেন।

২০০৫ সালে তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার প্রণীত ভোটার তালিকা নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিকে তার লেখা আর্টিক্যালের সূত্র ধরে পরবর্তীতে দেশে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণীত হয়। ২০০৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ মাঠের আন্দোলনে সরব তখন রুহেল যুক্ত হন তার বাবা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের পাশে স্থানীয় রাজনীতির মাঠে। ২০০৭ সালে ওয়ান ইলাভেন পরবর্তী পরিস্থিতিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের সাথে জাতীয় রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের প্রেসিডিয়াম সদস্য।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব রহমান রুহেল নিজের মনোনয়ন প্রত্যাশার কথা এড়িয়ে যান। তিনি তার বাবা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের জন্য দোয়া চান। মীরসরাইয়ের সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিনের বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম-১ সংসদীয় আসনে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মতো লিজেন্ডারি নেতা থাকায় তার সেই আশা বারবার হোঁচট খাচ্ছিল।

জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ৫০ বছর ধরে রাজনীতি করে আসা গিয়াস উদ্দিনকে প্রায় প্রতিদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও আদালত প্রাঙ্গণে নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের সেবা ও সহযোগিতা করতে দেখা যায়। নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকার কারণে তিনি ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের অনুপস্থিতিতে মীরসরাই আসনে তিনিই আওয়ামী লীগের মনোনয়নের যোগ্য দাবিদার।

আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন বলেন, মিরসরাইবাসীর সুখে-দুঃখে সবসময় পাশে থেকেছি। আশা করি, আগামী নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ত্যাগী হিসেবে আমাকে মূল্যায়ন করবেন।

আওয়ামী লীগ থেকে নতুনভাবে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে আলোচনায় আছেন স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স এসএসএফ ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই’র সাবেক পরিচালক ব্রিগিডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শামসুল আলম চৌধুরী। যিনি এলাকায় কর্নেল শামস নামেই অধিক পরিচিত। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়ার পরপরই তিনি দেশে বেশ আলোচিত হন। এরপর দেশে-বিদেশে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন।

তিনি বলেন, আসলে আমি সবসময় আমার এলাকার মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছি। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে মোশাররফ ভাইয়ের মতো সিনিয়র নেতা রয়েছেন।

আওয়ামী লীগ থেকে আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী বড়তাকিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নিয়াজ মোর্শেদ এলিট। তিনি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ক্রিকেট কাউন্সিলের পরিচালক, বাংলাদেশ জুনিয়র ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি জেনারেল ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

নিয়াজ মোর্শেদ এলিট বলেন, দলের কাছে মনোনয়ন চাইবো। আমার বিশ্বাস দল আমাকে মূল্যায়ন করবে। দল যদি অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয় সে ক্ষেত্রে নৌকার পক্ষে কাজ করবো।

অপরদিকে, মীরসরাই উপজেলা বিএনপির ধানের শীষে এবারের হাওয়া কিছুটা ঘূর্ণিপাকবেষ্টিত। কারণ এখানকার স্থানীয় বিএনপি ইতোমধ্যে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত। এদিকে দলীয় হাইকমান্ড থেকে দলের টিকিট পেতে আরও একাধিক প্রার্থীকে জোর লবিং চালাতে দেখা যাচ্ছে।

এবার বিএনপি থেকে এই আসনে মনোনয়ন দৌড়ে আছেন দলের নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় তৃণমূল থেকে উঠে আসা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল আমিন (চেয়ারম্যান), নেতাকর্মী সৃষ্টির কারিগর চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ নূরুল আমিন, সমাজসেবক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মীরসরাই উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী, বিএনপির প্রথম নির্বাচিত সংসদ সদস্য প্রয়াত ওবায়দুল হক খন্দকারের মেয়ে আমেরিকা প্রবাসী আইরিন পারভীন খন্দকার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি শিল্পপতি মনিরুল ইসলাম ইউসুফ, দলত্যাগী সাবেক এমপি এমএ জিন্নাহ, বেগম জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) জেড এ খান, চট্টগ্রাম উত্তরজেলা কৃষক দলের সভাপতি ও মীরসরাই কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ আতিকুল ইসলাম লতিফী এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি পারভেজ সাজ্জাদ।

মামলার ভয়ে মাঠ পর্যায়ে দেখা মেলা ভার আলোচনায় নাম আসা বিএনপির বেশিরভাগ মনোনয়নপ্রত্যাশীর। তবে দীর্ঘদিনের চলমান এই দ্বিধা-বিভক্তি জিইয়ে রেখেই বিএনপির প্রায় অর্ধ ডজনের বেশি সম্ভাব্য প্রার্থী যে যার মতো করে নেমেছেন মনোনয়ন লড়াইয়ে।

নুরুল আমিন বলেন, আমরা এখন সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে রাজপথে রয়েছি। এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সরকার যদি আমাদের দাবি মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয় তাহলে অবশ্যই বিএনপি নির্বাচনে যাবে এবং সেক্ষেত্রে আমি মিরসরাই আসন থেকে মনোনয়ন চাইবো।

এদিকে মিরসরাইতেও জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড অনেকটা স্থবির। যদিও গোপনে তাদের কার্যক্রম ঠিকই চলছে। জাতীয় পার্টিও এখানে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু মিলছে না যথাযথ অভিভাবক।

সকালের-সময়/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ