চট্টগ্রামের ফুটপাত যেন মৃত্যুফাঁদ, এতো মৃত্যুর দায় কার!


সকালের-সময় রিপোর্ট  ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১০:২৩ : অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম নগরীর ফুটপাতগুলো দিনে দিনে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। মৃত্যুর ঘটনা বাড়লেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষগুলো। দুর্ঘনায় নিহত পরিবারকে শুধুমাত্র বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ তারা। চলতি বছর বর্ষার শুরু থেকে এই পর্যন্ত ড্রেনে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৫ জন। আর গত এক মাসেই মারা গেছেন ৩ জন।

সোমবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে নগরীর ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ শেখ মুজিব সড়কে মাজার গেট এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হন সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া (১৯)। তিনি চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর রাত ৩টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের সদস্যরা নালা থেকে সাদিয়ার মৃতদেহ উদ্ধার করেন।

সেহেরীন মাহবুব সাদিয়ার মৃত্যুর ঘটনার দায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ঘাড়ে চাপিয়েছেন চসিক মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী।

নালা পরিষ্কার ও স্ল্যাব দেয়ার দায়িত্ব চসিকের হলেও মেয়রের দাবি— এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে সিডিএ’র নিয়ন্ত্রণে এই সড়কটি। তাই সেখানে চসিকের কোনো হাত নেই। সিডিএ’র অবহেলা ও অসতর্কতার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার (২৯ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন মেয়র। পরিদর্শন শেষে তিনি এ কথা বলেন।

সিটি মেয়র রেজাউল করিম বলেন, ‌আসলে যেটা দেখলাম আমাদের (সিটি করপোরেশনের) ফুটপাত প্রশস্ত ছিল। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের জন্য এটিকে কেটে দেড় ফুটে এনে ফেলছে। ফুটপাত কাটার পর এটিতে কোনো রেলিং দেয়া হয়নি। মেয়েটা নাকি কাদা থেকে ওপরে উঠতে দেড় ফুটের যে জায়গাটি আছে সেখানে পিছলে পড়ে গেছে। এখানে তাদের বেড়া দেয়া উচিত ছিল। অবহেলা আরকি।

তিনি আরও বলেন, এখানে উন্নয়নের কাজ হচ্ছে। যারা এটি বাস্তবায়ন করছেন (সাইট ইঞ্জিনিয়ার বা পিডি) তাদের দায়িত্ব ছিল জনগণের নিরাপত্তা দেয়া। খালের পাশে ফুটপাতটা দেড় ফুটে এনে রেখে দিয়েছে। দেড় ফুট জায়গা দিয়ে হাঁটতে গেলেতো সুস্থ মানুষও দিনের বেলায় পড়ে যাবে। রাতের বেলায় বাদও দিলাম।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সেখানে একটি লোহার নেট ছিল সেটিও তারা তুলে ফেলেছে। অন্তত নেটটা থাকলেও এই দুর্ঘটনা ঘটত না। আমি ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের খবর নিয়েছি। কাল রাত দুইটা পর্যন্ত আমি এটি মনিটরিং করেছি। আজকেও ঘটনাস্থল দেখতে গেছি।

দুর্ঘটনার জন্য কে দায়ী— এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, ‘দায়ী কারা এটা বলবো না। আপনারা জানেন এখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। রাস্তায় গর্ত হয়েছে। ফুটপাতের ওপর কাদা জমেছে। বৃষ্টির পর সেই কাদা পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল। কাদার ওপর পা পড়ার পর পিছলে মেয়েটি নালায় পড়ে গেছে বলে আমি শুনেছি। এখানে যারা প্রকল্পের কাজ করছে, তাদের সতর্ক হওয়া দরকার ছিল।

‘পানিতে রাস্তা এবং নালা এক হয়ে গেছে, মানুষ বুঝবে কিভাবে? খুঁটি গেড়ে লাল পতাকা টানিয়ে দিলেও তো মানুষ সতর্ক হতে পারতো। কিছুটা অবহেলা আছে। অবশ্যই আছে। যারা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করছে তাদের অবহেলা আছে।

ফুটপাতে স্ল্যাব ও রেলিং দেয়ার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের— বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলে মেয়র বলেন, আপনাদের অবগত করার জন্য বলছি, দেওয়ানহাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যে কাজ চলছে, এগুলো সিটি করপোরেশনের আওতায় নেই এখন।

এটার মেইনট্যানেন্স থেকে শুরু করে সমস্তকিছু চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এখানে বড় বড় গর্ত হয়েছে, আমি কয়েকদিন আগেও সিডিএ’র চেয়ারম্যানকে টেলিফোন করে অনুরোধ করেছি। তারপর থেকে উনার নির্দেশে গর্তে কিছু ভাঙা ইট দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আমি মনে করি, অবহেলা ও অসতর্কতার জন্য এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ড্রেনগুলো চিহ্নিত করে সেখানে বেষ্টনী দেয়া জরুরি। ড্রেনের যেসব পয়েন্ট বেশি ঝুঁকিপূর্ণ প্রয়োজনে সেগুলোতে দেয়াল দিতে হবে। আর এই জন্য প্রয়োজন সিডিএ ও চসিকের সমন্বয়।

উল্লিখিত সেবা সংস্থা দুটির সমন্বয় জরুরি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, তারা একসাথে কিংবা আলাদা সরেজমিনে পরিসংখ্যান করে একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। আর এই কাজটি করতে হবে খুব জরুরি ভিত্তিতে, দুই—চার দিনের মধ্যেই।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কপোর্রেশনের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, এর আগে কখনো ড্রেনে পড়ে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। হঠাৎ করে কেনো এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে সরেজমিনে পরিদর্শন করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানান তিনি।

এর আগে ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাট থানার মাঝিরঘাট রোডের ড্রেন থেকে অজ্ঞাত (৩৫) এক পুরুষের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের অভিমত, ড্রেনে পড়ে গিয়ে উঠতে না পেরে মারা গেছেন এই অজ্ঞাত এই পথচারী।

এছাড়া গত ২৫ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে মুরাদপুর এলাকায় রাস্তার পাশে ড্রেনে পড়ে তলিয়ে যান সালেহ আহমেদ নামে এক সবজি ব্যবসায়ী। এক মাস পেরিয়ে গেলেও নিখোঁজ সালেহ আহমেদকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি এখনো।

গত ৩০ জুন বুধবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে নগরীর ২ নম্বর গেট মেয়র গলিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সিএনজি অটোরিকশা খালে পড়ে নিহত হন খাতিজা বেগম (৬৫) ও সিএনজি চালক মো. সুলতান (৩৮)। তবে এই ঘটনায় সিএনজিতে বাকি তিনজনকে উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।

দুই নম্বর গেট মেয়র গলির টিঅ্যান্ডটি কলোনি এলাকা থেকে ডাক্তার দেখানোর জন্য সিএনজি অটোরিকশা করে মোট চারজন বের হন। এ সময় বাসা থেকে রওনা দিতেই সিএনজি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের খালের পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই ড্রেনের পানিতে ডুবে মারা যান ২ জন।

সকালের-সময়/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ