চট্টগ্রামে বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

‘কথিত বড় ভাইদের’ প্রশ্রয়ে চলে চাঁদাবাজি-খুন-ধর্ষণ!


নিজস্ব প্রতিবেদক ২৫ এপ্রিল, ২০২২ ৩:১২ : পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং এর অপতৎপরতা। বিশেষ করে নগরীর সংস্কৃতি ও মিডিয়াপাড়া হিসেবে পরিচিতি পাওয়া চেরাগী মোড় ও আশপাশের এলাকার লোকজন কিশোর গ্যাং এর উৎপাতে অতিষ্ঠ। আন্দরকিল্লা থেকে মোমিন রোড হয়ে জামালখান পর্যন্ত রাজনৈতিক কথিত বড় ভাইদের প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে উঠতি বয়সীরা।

আধিপত্য বিস্তার ও দলীয় কোন্দলে জড়িয়ে এক পক্ষ সদলবলে হামলে পড়ে প্রতিপক্ষের উপর। ঘটে খুনোখুনি ও রক্তারক্তির মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা। পুলিশ বলছে, গত শুক্রবার (২২ এপ্রিল) রাতে ছুরিকাঘাতে তারেক নামে যে কিশোর খুন হয়েছে, সেটিও আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে।

নগরীতে আলোড়ন তোলা এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে জামালখান এলাকায় এখন চলছে ফিসফাস, গুঞ্জন। আলোচনার টেবিল গরম করছে দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের পুরোনো দ্বন্দ্ব। যে দুই গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন এলাকারই দুই পরিচিত ‘বড় ভাই’য়ের অনুসারীরা।

জানা যায়, জামালখান, লালখানবাজার, চকবাজারসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় কথিত বড় ভাইদের নেতৃত্বাধীন কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এসব কিশোর গ্যাংয়ের অনেক সদস্য চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে খুব কম সময়েই ‘হাত পাকিয়ে’ ফেলেন। এসব গ্যাংয়ের নেতা হিসেবে আলোচনায় আছেন এলাকার চিহ্নিত বখাটে, ছিনতাইকারী, মাদক মামলার আসামি, এমনকি স্থানীয় কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরও।

স্থানীয় বাসিন্দা ও এলাকার দোকানিরা জানান, গত শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে নগরীর ব্যস্ততম আন্দরকিল্লা মোড়ে কিশোরদের একটি পক্ষ হঠাৎ করেই অন্য পক্ষকে ধাওয়া দেয়। এ সময় ১০/১২ জন কিশোরকে পালিয়ে মোমিন রোড হয়ে চেরাগী মোড়ের দিকে চলে আসতে দেখা যায়। তবে একজনকে ধরে কয়েকজন মিলে কিল-ঘুষি মারতে থাকে। তার পরনের শার্ট ছিঁড়ে ফেলা হয়।

উপস্থিত পথচারী ও স্থানীয় লোকজনের হস্তক্ষেপের পর মারামারিতে লিপ্ত হওয়া কিশোররা আন্দরকিল্লা ত্যাগ করে। এরপর রাত সাড়ে দশটার দিকে জামালখান চেরাগী মোড়ের ভেতরের দিকে গলিতে প্রতিপক্ষ বাগে পেয়ে যায় আসকার ইবনে তারেক ইভানকে। পেয়েই তাকে একের পর এক ছুরিকাঘাত করে প্রতিপক্ষের দুর্বৃত্তরা। এতে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখম হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বিএফ শাহীন কলেজের ছাত্র আসকার বিন তারেক ওরফে ইভান (১৮) জামালখান ওয়ার্ড ছাত্রলীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ও নগর ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহ-সম্পাদক সাব্বির সাদিকের অনুসারী। এর আগে ১৬ এপ্রিল দিবাগত রাতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়তলী এলাকায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষের এক পর্যায়ে ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান স্কুলছাত্র ফাহিম (১৫)।

চেরাগীর ঘটনায় গতকাল শনিবার নিহত ইভানের বাবা এসএম তারেক বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় শোভন দেব (১৭) নামে একজন আটক করা হয়েছে। এ মামলায় ৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। শোভন দেব ছাড়া বাকি সাত আসামি হলেন— ধ্রুব (২০), প্রান্ত (২০), শ্রাবন (২০), শচীন (২০), রুবেল দত্ত (২০), অর্ক (২০) এবং মহান চৌধুরী (১৮)।

পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাং কালচার এখন চেঞ্জ হয়ে গেছে। আসলে কারা কিশোর গ্যাং আর কারা বন্ধু বা রাজনৈতিক নেতাকর্মী সেটাই ফারাক করা দুষ্কর। ২০১৯ সালে সিএমপি থানা ভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা করলেও সেটি গত তিন বছরে হয়নি হালনাগাদ। ফলে কিশোরদের মধ্যে সামান্য কথা কাটাকাটিতেই খুনের মতো ঘটনা ঘটলেও এর পেছনে কোন গ্যাং জড়িত সেটাও আড়ালে থাকছে অনেকটাই। এরপর খুনের পর জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজন কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হলেও গ্যাং লিডার তাদের প্রশ্রয়দাতা কথিত বড় ভাইরা থাকছেন বরাবরই আড়ালে।

২০১৯ সালে করা সিএমপির তালিকায় বলা হয়েছিল- সিএমপির কিশোর গ্যাংয়ে মোট কিশোরের সংখ্যা ৫৩৫ জন। আর তাদের গ্যাংয়ের সংখ্যা ৪৭টি। তাদের নিয়ন্ত্রক কথিত বড় ভাইদের বেশিরভাগই সরকার দলীয় রাজনৈতিক নেতা নামধারী। তাদেরই বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের পদে না থাকলেও তারা সরকার দলীয় এমপি-মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতাদের বিশ্বস্ত অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে কিশোর গ্যাং পরিচালনা করে থাকেন। তাদের নামের হিসেবেই মূলত গ্যাংয়ের সংখ্যা ধরেছিল পুলিশ।

সিএমপির পশ্চিম বিভাগের চার থানায় কিশোর গ্যাং গ্রুপের সংখ্যা ১৪টি ও সদস্য সংখ্যা ৯৩ জন। এর মধ্যে ডবলমুরিং থানায় গ্রুপের সংখ্যা ৭টি ও সদস্য সংখ্যা ৪৫ জন। পাহাড়তলী থানায় সদস্য সংখ্যা ২২ জন ও গ্রুপের সংখ্যা ৩টি। হালিশহর থানায় গ্রুপের সংখ্যা ২টি আর সদস্য সংখ্যা ১৩ জন। আকবর শাহ থানায় সদস্য সংখ্যা ১৩ জন আর গ্রুপ হচ্ছে ২টি।

বন্দর বিভাগের দুই থানায় কিশোর গ্যাংয়ের নাম পুলিশের তালিকায় থাকলেও কর্ণফুলী ও পতেঙ্গায় কোনও কিশোর গ্যাং নেই বলে দাবি করেছিল পুলিশ। ইপিজেড থানায় গ্রুপের সংখ্যা একটি আর সদস্য সংখ্যা ৮ জন। অন্যদিকে বন্দর থানায় গ্রুপের সংখ্যা ৩টি এবং সদস্য সংখ্যা ৩০ জন।

সিএমপির দক্ষিণ বিভাগের চার থানায় গ্যাং গ্রুপের মোট সংখ্যা ১৬টি আর সদস্য সংখ্যা ৩১৬ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর অপরাধীর সংখ্যা কোতোয়ালী থানায়। যার সদস্য সংখ্যা ১৫০ জন ও গ্রুপের সংখ্যা ৪টি। বাকলিয়া থানার গ্রুপের সংখ্যা ৩টি আর সদস্য সংখ্যা ১৮ জন। চকবাজারে গ্রুপের সংখ্যা ৭টি ও সদস্য সংখ্যা ১১৮ জন। সদরঘাট থানায় গ্রুপের সংখ্যা ২টি ও সদস্য সংখ্যা ৩০জন।

একইভাবে সিএমপির উত্তর বিভাগের চার থানায় কিশোর গ্যাং গ্রুপের সংখ্যা ১৩টি ও সদস্য সংখ্যা ৮৮ জন। এর মধ্যে চান্দগাঁও থানায় গ্রুপের সংখ্যা ২টি ও সদস্য সংখ্যা ৩০জন। পাঁচলাইশ থানায় সদস্য সংখ্যা ১৮ জন ও গ্রুপের সংখ্যা ৩টি। খুলশী থানায় গ্রুপের সংখ্যা ৬টি আর সদস্য সংখ্যা ৩২ জন। বায়েজিদ থানায় গ্রুপ ২টি এবং সদস্য সংখ্যা আট।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমাদের সমাজে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার মিল পাচ্ছে না অনেকে। নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিশোররা। তাদের আচরণে পরিবর্তন হচ্ছে। কিশোর বয়সে হিরোইজম ভাব থাকে। এই হিরোইজমকে সঠিক পথের অনুসারী করে তুলতে হবে।

আবার কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে। এর দায় আমাদের সবার। সমাজের শিক্ষক, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধি বা যাদের কথা শুনবে এমন ব্যক্তিদের নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে এই গ্যাং কালচার থেকে বিপদগামী কিশোরদের সুপথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

সপ্তাহের ব্যবধানে দু-দুজন কিশোর অপর কিশোরদের হাতে খুন হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ প্রশাসন। কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা হালনাগাদ করার পাশাপাশি এই গ্যাং কালচার দমাতে তিন উপায়ে কাজ করার কথা ভাবছে পুলিশ।

এ বিষয়ে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর জানান, কিশোর গ্যাং নেই সেটা বলা যাবে না। তালিকা করাটা চলমান প্রক্রিয়া। তবে কিশোর গ্যাংকে শনাক্ত করাটা টাফ। কেননা যাকে তাকে কিশোর গ্যাং লিডার বা গ্যাংয়ের সদস্য বানিয়ে দেয়া যায় না। পুলিশ তা করবেও না।

তিনি আরও বলেন, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে, এসব খুন-খারাবি বন্ধে আমরা তিনটি বিষয় নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছি। প্রথমত নতুন করে কিশোর গ্যাংয়ের সলিড তালিকা তৈরি করে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। দ্বিতীয়ত কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত কিশোরদের অভিভাবকদের ডেকে এনে কাউন্সিলিং সভা করা। তৃতীয়ত এসব গ্যাং কালচারে যেসব কথিত বড় ভাইরা ছায়া হয়ে আছেন তাদেরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আইনের আওতায় আনা।

সকালের-সময়/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ