তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি শুরু হয়ে গেছে!


আন্তর্জাতিক ডেস্ক  ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১:৫০ : অপরাহ্ণ

এক বছর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি গোটা বিশ্ব জেগে উঠতে শুরু করেছিল ইউরোপে আবার যুদ্ধ শুরু হয়েছে, এই খবর শুনে। কিয়েভে ভোরের আলো ফোটার আগেই আঘাত করছিল একের পর এক রুশ ক্ষেপণাস্ত্র, শহর ছেড়ে পালাচ্ছিল হাজার হাজার মানুষ।

এরপর ক্রেমলিন থেকে এসেছিল রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের এক কঠোর হুঁশিয়ারি। আমাদের কাজে যারাই বাধা দেবে, বা আমাদের দেশকে হুমকি দেবে, তাদের জেনে রাখা উচিত, রাশিয়া সাথে সাথে পাল্টা জবাব দেবে। এর পরিণতি হবে এমন, যা ইতিহাসে কেউ আগে দেখেনি, শত্রুপক্ষকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন তিনি। এই যুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাতে কেবল ইউক্রেন বা ইউরোপ নয়, গোটা পৃথিবীর রাজনীতি-কূটনীতি-অর্থনীতিতে শুরু হয়েছে এক বিরাট অস্থিরতা।

ইউক্রেন যুদ্ধের অবস্থা এখন কী? এই সংঘাতের শেষ কোথায়? এই যুদ্ধ কীভাবে পাল্টে দিয়েছে বিশ্বপরিস্থিতি? ইউক্রেন যুদ্ধ কি আসলে আরও একটি মহাযুদ্ধের শুরু মাত্র? বিশেষ করে যেভাবে বিভিন্ন দেশ ইউক্রেনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে, তাতে কেউ কেউ এটিকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা বলে বর্ণনা করছেন। খবর বিবিসি বাংলার।

এদিকে রাশিয়াকে মোকাবেলায় প্রতিনিয়ত ইউক্রেনে ঢুকছে পশ্চিমা অত্যাধুনিক অস্ত্র। ‘অন্তহীন’ এই যুদ্ধে রীতিমতো একা লড়ছে রাশিয়া। এক বছরে লাখো মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, ঘর হারিয়েছে কোটি মানুষ। পৃথিবীজুড়ে পড়েছে যুদ্ধের প্রভাব। যদিও এই এক বছরে যুদ্ধ থামানোর স্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত দেননি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। কয়েক দফা শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর নতুন করে টেবিলে বসার সুস্পষ্ট বার্তা দেননি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কিও।

তার পশ্চিমা মিত্ররাও এ পর্যায়ে এসে যুদ্ধের আগুন নেভানোর ইচ্ছা দেখাচ্ছেন না। চলমান এই রণাঙ্গনের এক প্রান্তে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আরেক প্রান্তে পশ্চিমা তিন (ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো) পক্ষ। এর ফলে যুদ্ধ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে দিন দিন। এই যুদ্ধ দৃশ্যত অন্তহীন।

এক বছর আগের এই দিনে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন পুতিন। তার আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে তার সঙ্গে আলোচনার টেবিলে পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা পার করেছেন ব্যস্ত দিন। প্রতিবেশী ইউক্রেনের সীমান্তে দেড় থেকে দুই লাখ সেনা সমাবেশ করা পুতিনকে থামাতে নিষেধাজ্ঞাও দিয়ে গেছে পশ্চিমারা। কাজের কাজ হয়নি তাতে।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে যুক্ত হতে চেয়েছিল ইউক্রেন। পুতিন চেয়েছিলেন ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ আর ইউক্রেনের সদস্যপদপ্রাপ্তি ঠেকাতে। এ নিয়ে চরম উত্তেজনার মধ্যে পুরোদমে যুদ্ধ শুরু করেন রুশ প্রেসিডেন্ট। সে সময় ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা থাকা দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন ঘোষণা করেন রুশ প্রেসিডেন্ট। তিনি সেখানে ‘শান্তিরক্ষী’ মোতায়েনের নির্দেশ দেন, যাকে হামলার শুরু হিসেবে আখ্যা দেয় পশ্চিমারা।

প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বেশ কিছু দেশ এবং তাদের এশীয় মিত্র জাপান নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাশিয়ার নানা প্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর। এর পর থেকে যুদ্ধ চলতে থাকে সমরের নিয়মে। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আর ইউক্রেনে পশ্চিমা অস্ত্র আসতে থাকে পর্যায়ক্রমে।

যুদ্ধের বার্ষিকীর আগে পোল্যান্ড থেকে ট্রেনে চড়ে কিয়েভে গিয়ে জেলেনস্কির পিঠ চাপড়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। রাশিয়ায় উড়ে গিয়ে পুতিনের সঙ্গে দেখা করে দোস্তি দেখিয়েছেন চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই। দুই পক্ষের অনড় এ অবস্থানে ভুগছে সাধারণ মানুষ। দ্রব্যমূল্য বেড়েছে রাশিয়ায়।

নিষেধাজ্ঞায় শ্লথ হয়ে গেছে অর্থনীতির চাকা। ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তায় দেশটির অবস্থাসম্পন্ন অনেকে ছুটেছেন থাইল্যান্ডের দিকে। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে নিজ দেশে বা প্রতিবেশী রাষ্ট্রে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয় খুঁজেছে ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি ইউক্রেনীয়। যুক্তরাষ্ট্র আর মিত্রদের দেয়া ঋণের বোঝায় ভারী হচ্ছে জেলেনস্কির কাঁধ। যুদ্ধকে তবু আটকানো যাচ্ছে না দিয়ে কোনো বাঁধ।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রুশ বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য যখন ঢুকে পড়েছে ইউক্রেনে, বিশাল এক ট্যাংক আর সাঁজোয়া বহর এগিয়ে যাচ্ছে কিয়েভের দিকে, তখন ইউক্রেনের পরাজয় মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর একটি দেশের বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ে ইউক্রেন কতদিন টিকতে পারবে, তা নিয়ে অনেকেই ছিলেন সন্দিহান। কিন্তু এক বছর পর এই যুদ্ধ এখনো চলছে। যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সবাইকে যা অবাক করেছে, তা হলো রাশিয়ার মতো এক বিরাট ক্ষমতাধর দেশের সামরিক দুর্বলতা। যুদ্ধে প্রথম কিছু সাফল্য দেখালেও রাশিয়াকে ইউক্রেনের অনেক এলাকা থেকে পিছু হটতে হয়েছে।

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সমর বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, এই যুদ্ধ শুরুর সময় রাশিয়ার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল তিনটি। প্রথম, কিয়েভে, মস্কোর ভাষায়, যে নাৎসীবাদীরা ক্ষমতায়, তাদের উৎখাত করা; দ্বিতীয়ত ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীকে নিরস্ত্র করা; তৃতীয়ত, ইউক্রেন যেন কোনোদিন নেটো জোটের সদস্য হতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা।

‘নাৎসি বলতে প্রেসিডেন্ট পুতিন কাদের বুঝিয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। তবে দক্ষিণ ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষী মানুষের বিরুদ্ধে আযভ ব্যাটালিয়ন নামে যে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি তৎপর ছিল, তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করতে পেরেছে রাশিয়া। কাজেই বলা যায়, প্রথম লক্ষ্য তারা অর্জন করেছেন।’ তাদের দ্বিতীয় লক্ষ্য, ইউক্রেনীয় বাহিনীকে নিরস্ত্র করা, সেক্ষেত্রে তো রাশিয়া সফল হয়নি?

সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, ‘যুদ্ধে রুশ বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও, ইউক্রেনীয় বাহিনীও কিন্তু বেশ দুর্বল হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন নেটো জোটের কাছ থেকে বিপুল সামরিক সহায়তা পেয়েছে, আরও পাবে বলে প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। এসব প্রতিশ্রুতি যদি বাস্তবায়িত হয়, ইউক্রেনের বাহিনী আরও বেশ কিছুদিন যুদ্ধ করে যাবার শক্তি পাবে। সুতরাং বলা যেতে পারে ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়নি।

তৃতীয়ত, নেটো জোটে কিন্তু ইউক্রেন এখনো যোগ দিতে পারেনি। যতদিন সেখানে যুদ্ধ চলছে, ইউক্রেনের কিছু অস্ত্র রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকছে, ততদিন হয়তো ইউক্রেন নেটো জোটের অংশ হতে পারবে না।’ ‘কাজেই বলা যেতে পারে রাশিয়া তাদের কিছু লক্ষ্য অর্জন করেছে, কিছু করতে পারেনি,’ বলছেন সৈয়দ মাহমুদ আলী।

যুদ্ধের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো যে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, তার লক্ষ্য ছিল রাশিয়াকে দুর্বল করা, একঘরে করে ফেলা। শুরুতে রুশ অর্থনীতিতে এর বিরাট ধাক্কা লেগেছিল। পশ্চিমা কোম্পানিগুলো যখন একের পর এক রাশিয়া থেকে ব্যবসা গোটাতে শুরু করে, রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো কঠিন করে তোলা হয়, তখন রুশ মুদ্রা রুবলের মানে বিরাট ধস নামে।

অন্যদিকে, ইউরোপের যেসব দেশ নেটো সামরিক জোটে যোগদানের পক্ষে একটা নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল, সেসব দেশ একের পর এক নেটো জোটে যোগ দেবে বলে ঘোষণা দিতে থাকে। তার মানে, যুদ্ধের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পুতিন যা অর্জন করতে চেয়েছিলেন, নেটোকে ঠেকানো— যুদ্ধের কারণে কি তার উল্টো ফল হয়নি?

সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্য রাশিয়ার বিপক্ষে চলে গেছে কিনা, সেটা নিয়ে দু ধরনের মতামতই আছে। একদিকে নেটো বলছে, রাশিয়া প্রচণ্ডভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক— সমস্ত দিক থেকে। বৃহৎ সামরিক শক্তি হিসেবে রাশিয়ার যে একটা বিরাট ভাবমূর্তি ছিল, সেটা নষ্ট হয়েছে। তাদের সেনাবাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কাজেই রাশিয়া দেখতে যতটা শক্তিধর মনে হয়, কার্যত তারা ততটা নয়।

সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, ইউরোপের অনেক দেশ এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলে গেলেও বাকি বিশ্ব, বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলো কিন্তু সেরকম কট্টর কোনো অবস্থান নেয়নি। কাজেই রাশিয়া এক ঘরে হয়ে গেছে এটা বলা যাবে না। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ধসে পড়লো, তখন কমিউনিজমের পতনকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয় বলে ঘোষণা করেছিলেন অনেকে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা তো ‘দ্য এন্ড অব হিস্ট্রি এন্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ বলে একটা বই লিখে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইউরোপে আবার এক রক্তাক্ত যুদ্ধে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব ব্যবস্থা উলট-পালট হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একজন শিক্ষক, সৈয়দ ইফতেখার আহমেদ বলেন, এই যুদ্ধ বিশ্বরাজনীতিকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার ধারণা ছিল, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটবে, অর্থাৎ, ইউরোপে বোধহয় আর কোনো যুদ্ধ ঘটবে না। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে উদার গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আধিপত্য কায়েম হবে। কিন্তু তাদের হিসেবে একটা বড় ভুল ছিল।

রাশিয়ার যে আবার পুনরুত্থান ঘটতে পারে, সেখানে যে একটি পশ্চিমা-বিরোধী রুশ জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে, এই সমীকরণটা গোনায় ধরা হয়নি। প্রেসিডেন্ট পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া তার অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তিকে সংহত করার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে আসলে এক বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।

বিশ্বজুড়ে এখন যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রাধান্য, এটি বজায় থাকবে কিনা, সেটাই কিন্তু এখন পশ্চিমা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা। তিনি বলেন, সবকিছুই এখন নির্ভর করছে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফলের ওপর। ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে গত কদিন ধরে যে খবরটি সবচেয়ে বড় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে, তা হলো চীনের ভূমিকা।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিনেকন বলেছেন, তাদের কাছে এমন গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে, যে, চীন রাশিয়াকে হয়তো সামরিক অস্ত্রশস্ত্র জোগান দিতে পারে। সামরিক সরঞ্জামের অভাবে রাশিয়া এখন বেকায়দায় আছে। কাজেই চীন যদি সত্যি সত্যি রাশিয়াকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, তাহলে সেটিকে অনেক বিশ্লেষক একটা ‘গেম চেঞ্জার’ বলে বর্ণনা করছেন। চীন যদি এই কাজ করে, তাহলে কি পুরো পরিস্থিতি আমূল বদলে যেতে পারে?

এ প্রশ্নের উত্তরে সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, বহু দশক ধরে পশ্চিমা দেশগুলোর একটা বড় দুশ্চিন্তা ছিল, রাশিয়া এবং চীন যদি তাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়, তখন কী হবে। ইউরেশিয়া— অর্থাৎ ইউরোপ এবং এশিয়া, দুই মহাদেশজুড়ে যে বিশাল ভূখণ্ড, সেখানে যদি কোনোদিন একটি দেশ, বা একাধিক দেশের মৈত্রী জোট যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটা বিরাট বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এজন্যেই কিন্তু পশ্চিমা শক্তি রাশিয়াকে চীন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। তারা চীনকে একঘরে করে চীন-বিরোধী সংগ্রামের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেটা হয়নি। পশ্চিমা দেশগুলোকে এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়া এখন চীনের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে।–চীন রাশিয়াকে সরাসরি সামরিক সহায়তা দেবে কিনা, বা কতদূর দেবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন, চীন তাদের মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কথা মাথায় রেখে এই সিদ্ধান্ত নেবে। যদি চীন এবং রাশিয়া সত্যি একটি মৈত্রী জোটে পরিণত হয়, যখন নেটো কিনা ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে একটি প্রক্সি ওয়ার বা পরোক্ষ যুদ্ধ চালাচ্ছে, তখন বিশ্ব রাজনীতিতে আমরা একটা বিরাট বিভাজন বা দ্বি-মেরুকরণ দেখবো। এর একদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটো জোট, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া এবং তাদের সহযোগী দেশগুলো।

সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন, এটি হবে বিশ্বরাজনীতির জন্য খুবই বিপজ্জনক এক মোড়। এই দুই মেরুর দেশগুলোর মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছে, যাদের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি পরমাণু শক্তিধর দেশ, এই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের শক্তি, ক্ষমতা এমনকি ইচ্ছে পর্যন্ত যাদের আছে, সেখানে গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।

কয়েকদিন আগে প্রেসিডেন্ট পুতিনের এক সাবেক মুখপাত্র, সের্গেই মারকভ, যিনি এখন মস্কোর ইন্সটিটিউট অব পলিটিক্যাল স্টাডিজের একজন পরিচালক, বিবিসিকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। ইউক্রেনে এখন যে যুদ্ধ, সেটি তার ভাষায়, আসলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেটোর যুদ্ধ। তার মতে, ইউক্রেনের এই হাইব্রিড যুদ্ধ কার্যত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক সৈয়দ ইফতেখার আহমেদ অবশ্য এই যুদ্ধকে এখনই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলতে রাজি নন, তবে এরকম একটা যুদ্ধের সম্ভাবনা তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না। এটা হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয়। কিন্তু এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে যে মেরুকরণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতে করে যুক্তরাষ্ট্র হতে শুরু করে ইউরোপের অনেক দেশই কিন্তু পরোক্ষভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।

রাশিয়ার অনেক নীতি নির্ধারকও মনে করেন, রাশিয়া এখন পশ্চিমাদেশগুলোর বিরুদ্ধে লড়ছে। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা হুমকি যে তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ