শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ, ৫ বছরেও ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ!


মোহাম্মদ ফোরকান ২০ জুন, ২০২০ ৩:০৯ : অপরাহ্ণ

অনিয়ম দুর্নীতি আর অভিযোগের পাহাড় জমে উঠেছে ফটিকছড়ি করোনেশন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০১৪-২০১৬ তৎকালিন ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধে। শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে ঘুষসহ নানা অভিযোগের ভারে নুয়ে পড়েছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। ঐতিহ্যবাহি এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারি নিয়োগে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে অভিযোগের কমতি নেই।

জানা যায়, ফটিকছড়ি করোনেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক ও ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষককে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয় ২০১৪-২০১৬ তারিখের ম্যানেজিং কমিটি। এ অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ও নিয়োগ প্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক প্রধান শিক্ষক মো: জসিম চৌধুরী ও ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক মাওলানা আবদুল্লাহ আল মাছউদ কাদেরীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে, দু্র্নীতি দমন কমিশন, জেলা প্রশাসক, শিক্ষা বোর্ডে অভিযোগ দাখিল করেছেন সাবেক ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মো: লোকমান হাকিম।

তার এই অভিযোগের পরিপেক্ষিতে ২২ জুলাই ২০১৫ সালে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে তৎকালিন ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ দিয়েছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এর পর গত ২৭ আগষ্ট ২০১৫ সালে উভয়পক্ষকে নোটিশ জারি করে অভিযোগের বিষয়ে ৩০ আগষ্ট ২০১৫ তারিখ সকাল ১১ টায় শুনানি হয়।

এর পর বিগত ১৯ আগস্ট ২০১৫ সালে জেলা প্রশাসনের সহকারি কমিশনার (শিক্ষা) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শারমিন আখতার স্বাক্ষরিত শিক্ষা বোর্ডে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছিল, বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের অভিভাবক সদস্য লোকমান হাকিমের অভিযোগের ভিত্তিতে তৎকালিন বিদ্যালয়ের সভাপতি আলহাজ্ব মো: ইসমাইল হোসেনের স্বজনপ্রীতি, একগুঁয়েমি ও অদুরদর্শিতা এবং শিক্ষক-কর্মচারি নিয়োগে দুর্নীতি তদন্ত করে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডকে প্রতিবেদন দেয়ার অনুরোধ করা হলেও তারা সেই দুর্নীতি তদন্ত এখনো করেনি। অদৃশ্য কারণে সেই বিভিন্ন দপ্তরের তদন্ত এখনো আটকে আছে।

দুর্নীতির বিষয়ে তৎকালিন দৈনিক পূর্বকোণ, দৈনিক আজাদী ও বাংলা নিউজে রিপোর্ট করা হয়..

শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বছরের পর বছর এসব নিয়োগ জালিয়াতির সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদ যেমন জড়িত থাকে, তেমনি এসব প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে শিক্ষা বোর্ড ও অধিদপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের সাথে ম্যানেজিং বোডির আতাত রয়েছে। তারা অর্থের বিনিময়ে এসব কাজ করেন বলেও অভিযোগ আছে।

অভিযোগের বিষয়ে অভিভাবক সদস্য লোকমান হাকিম সকালের-সময়কে বলেন, শতবর্ষ পুরোনো এই বিদ্যালয়ে সুনাম রয়েছে, কিন্তু এখানে শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্যসহ স্কুলে লুটপাটের উৎসব চলছে। তৎকালিন সভাপতি মো: ইসমাইল হোসেনের একক সিদ্ধান্তে বিদ্যালয়ের পুরানো ভবন ভেঙ্গে বিক্রি করা হয়েছে। নতুন কক্ষ নির্মাণের নামে বিদ্যালয়ের তহবিল তছরুপ করা হয়েছে। সর্বশেষ সহকারি প্রধান শিক্ষক মো: জসিম চৌধুরী ও ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক মাওলানা মাছউদকে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে অনিয়ম করা হয়েছে। যা কোনভাবেই বিষয়টি মেনে নিতে পারিনি।

করোনেশন বিদ্যালয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ায় নিয়ম থাকলেও এ নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় নম্বরপত্রে কাটাছেঁড়া করে লিখিত ও মৌখিক পরিক্ষায় দুই দুইবার ফেল করা মো: জসিম চৌধুরীকে নিয়োগ দেয়া হয় সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে। যে কারণে তৎকালিন ডিজি’র প্রতিনিধি নিয়োগ দুর্নীতির কথা জানতে পারায় তার সাথে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পরেছিল ম্যানেজিং কমিটি।

মো: লোকমান হাকিমের অভিযোগের বিক্তিতে আরও জানা যায়, করোনেশন স্কুলে বিভিন্ন দুর্নীতি, স্বজন প্রীতি, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা সহ বিদ্যালয়টি অতীত ঐতিহ্য হারাতে চলছে। বিষয় গুলোসহ বিগত ২৭ মে ২০১৫ ইংরেজী তারিখে অনুষ্ঠিত সহকারী প্রধান শিক্ষক ও ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের ১ম ইন্টারভিউতে ব্যাপক অনিয়মের বিষয়ে জেলা প্রশাসক বরাবরে একখানা আবেদন গত ৬ জুন ২০১৫ ইংরেজী তারিখে দাখিল করে।

অভিভাবক সদস্য মো: লোকমান হাকিমের  অভিযোগের ফটোকপি

আবার ১৭ আগষ্ট ২০১৫ ইংরেজী অনুষ্ঠিত ২য় ইন্টারভিউ বন্ধ করার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবরে বিগত ১২আগষ্ট ২০১৫ ইংরেজি তারিখে আরেকটি আবেদন দাখিল করে। এরপর ও ইন্টারভিউ স্থগিত না হওয়ায় বিগত ১৭আগষ্ট ২০১৫ ইংরেজী তারিখে সকাল ১০ টায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর অভিযোগ দাখিল করে। তার পরও ইন্টারভিউ বন্ধ করেনি ম্যানেজিং কমিটি। এর পর বিষয়টি ৩০ আগষ্ট ২০১৫ ইং তারিখে উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি তদন্ত করেন।

তদন্তে সহকারী প্রধান শিক্ষক মো: জসিম চৌধুরী ও মাওলানা মাছউদকে নিয়োগের দুর্নীতির বিষয়ে ২৭ মে ২০১৫ ইংরেজি তারিখে ইন্টারভিউ সম্পর্কিত অনিয়ম দুর্নীতি সম্পর্কে অভিযোগের প্রমান পায় উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি। সেখানে সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগের কাগজপত্র পরিক্ষাকালে দেখা যায়, ফলাফল সিটে ডিজির প্রতিনিধির সাক্ষর রয়েছে, কিন্তু পরিক্ষায় খাতায় প্রদত্ত মার্কস কাটাকাটি হয়। যার ফলে পরিক্ষাটি বাতিল করা হয়।

পরবর্তীতে ম্যানেজিং কমিটির সভায় আলোচনা না করে পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়, যা মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভনিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা ২০০৯ এর প্রজ্ঞাপনের পরিপন্থি।

ইসলাম ধর্ম বিষয়ে মহিলা শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগের বিষয়ে তদন্তকালে সহকারী কমিশনার ভূমি জানতে পারেন, বিজ্ঞপ্তির পর কোন মহিলা প্রার্থী না থাকায় পুরুষ প্রার্থী নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু লিখিত পরিক্ষায় সর্বোচ্চ ২২ মার্কস প্রাপ্ত প্রার্থীকে মৌখিক পরিক্ষায় কম মার্কস দিয়ে লিখিত পরিক্ষায় ২০ মার্কস প্রাপ্ত প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

তৎকালিন ফটিকছড়ি সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো: জামিরুল ইসলামের দেয়া তদন্ত রিপোর্ট 

এতেই প্রমান হয়ে যায়, সহকারী প্রধান শিক্ষক মো: জসিম চৌধুরী ও ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক মাওলানা আবদুল্লাহ আল মাছউদ বড় ধরনের ঘুষ দিয়ে এই চাকুরী নিয়েছেন। সহকারী কমিশনার ভূমি অভিযোগের তদন্ত রিপোর্টে এই দুর্নীতির কথা প্রকাশ করিলেও আজ প্রায় ৫ বছর অতিক্রম হয়ে গেলেও দায়ী ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে কোনরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

মো: লোকমানের অভিযোগে আরও জানা যায়, সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে তৎকালিন পরিচালনা পরিষদের সভাপতির মনোনীত প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার জন্য বিগত ০২ ডিসেম্বর২০১৫ ইং তারিখে আইওয়াশের ইন্টারভিউ করে ১ম ও ২য় ইন্টারভিউতে সভাপতির মনোনিত ঐ পার্থীকে পাশ করাতে না পেরে ৩য় বার ও আইওয়াশের ইন্টারভিউ করে যোগসাজশে সরাসরি মো: জসিম ও মাওলানা মাছউদ নিয়োগ দিয়ে দেন।

এ বিষয়ে তখন অভিভাবক সদস্য মো: লোকমান হাকিম সরকারি দপ্তরে অনেকগুলো অভিযোগ করেন, জেলা প্রশাসক বরাবর ৬/৭/২০১৫ ও ১২/০৮/২০১৫ ইং তারিখ, দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম প্রধাণ কার্যালয়ে ১৩/১২/২০১৫ ইং তারিখ, উপ পরিচালক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, আগ্রাবাদ ১৪/১২/২০১৫ ইং তারিখ, জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়, আগ্রাবাদ ২৫/১১/২০১৫ ইং তারিখ, এবং দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান কার্যালয় ২৭/৯/২০১৬ তারিখে বাদী হয়ে এই অভিযোগ গুলো দাখিল করেন।

এ বিষয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক মো: জসিম চৌধুরী মোঠোফোনে সকালের-সময়কে বলেন, লোকমান হাকিমের অভিযোগের পর একবার প্রধান মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ঘুষের বিষয়ে সরাসরি আমার কাছে এসে অফিসাররা জেরা করেছিল, আমি তখন তাদের ১০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলাম, তারা আমার কথা শুনে টাকা না নিয়ে চলে যান, কেনো টাকা দিতে চেয়েছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে জসিম উদ্দীন প্রতিবেদকে জানান, অনেক দুর থেকে এরা এসেছিল তাই তাদের খামে করে ১০ হাজার টাকা সম্মানি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা নেননি।

দুর্নীতি দমন কমিশনে দেয়া মো: লোকমান হাকিমের অভিযোগ

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের একজন শিক্ষা অফিসার নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকালে-সময়কে জানান, ফটিকছড়ি করোনেশন স্কুলে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহিতাদের বিরুদ্ধে যতাযত ব্যবস্থা নেয়া হবে। বর্তমানে দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে নতুন করে অভিযোগ পেলে খোজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রাণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকালের-সময়কে বলেন, আমরাও শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে প্রচুর অভিযোগ পাচ্ছি। আসলে বিকেন্দ্রীকরণের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিও ছড়িয়ে পড়েছে। এর অর্থ এই নয় যে কোথাও দুর্নীতি হচ্ছে না। শিক্ষকরাও চাকুরী পাওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিচ্ছে এবং ম্যানেজিং কমিটিও ঘুষ নিচ্ছে, এই দুর্নীতি এখন একটি বড় সমস্যা। এর পরও আমরা নতুন করে অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

প্রিয় পাঠক.. করোনেশন স্কুলে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির আরও নতুন নতুন তথ্য জানতে আগামী পর্বে চোঁখ রাখুন।

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ