সরকার ঋণের সুবিধা দিলে ডেইরি শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে: নাজিম উদ্দিন


মোহাম্মদ ফোরকান ২৬ আগস্ট, ২০১৯ ১:৫২ : পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে পশ্চিম পটিয়ায় সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই সম্পূর্ণ ব্যক্তি-উদ্যোগে গড়ে উঠেছে পাঁচ শতাধিক ডেইরি ফার্ম। এসব ডেইরি ফার্মে দুগ্ধ প্রদানকারী গাভী রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। দৈনিক দুধ উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৬০ হাজার লিটার। গাভী পালন করে চট্টগ্রামের পটিয়ার ৬ শতাধিক পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। তাদের দেখাদেখি আশপাশের অন্যরাও গাভী পালনে ঝুঁকেছেন। তবে খাদ্য সঙ্কট, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকা এবং বিভিন্ন কারণে খামারিদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

খামারিরা জানান, শুরুতে দু-তিনটি গাভী দিয়ে বেকার যুবকরা ডেইরি ফার্ম গড়ে তোলেন। বর্তমানে ওইসব ডেইরি ফার্মে গাভীর সংখ্যা বেড়ে ১০০ থেকে ১৫০টি দাঁড়িয়েছে। ২২টি ইউনিয়ন নিয়ে পটিয়া উপজেলা।  তার মধ্য পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে প্রায় সব বাড়িতে খামার গড়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশ থাকায় একজনের দেখাদেখি অন্যরা উদ্বুদ্ধ হয়ে একের পর এক খামার গড়ে তুলেছেন।

খামারীরা জানান, সরকারি কোনো সহযোগিতা তাদের ভাগ্যে জোটেনি। প্রথম অবস্থায় গোখাদ্যের অভাব না থাকলেও এখন খামারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক খাদ্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।

খামারিরা আরো জানান, ১৯৯০ সালে সর্বপ্রথম এই এলাকায় খামার গড়ে ওঠে। ওই সময়ে সরকার প্রতিটি খামারিকে গরুপ্রতি ৭ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে নতুন পুরাতন আর কোন সহযোগীতা সরকার থেকে তারা পাননি। ফলে নিজ সংগ্রামেই তাদের টিকে থাকতে হচ্ছে।

এছাড়া ফার্মগুলোতে দৈনিক প্রায় ৬০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদিত হলেও দুধ প্রক্রিয়াজাত করার কোনো প্লান্ট না থাকায় বাধ্য হয়েই কম দামে মিষ্টি তৈরীর কারখানায় দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে। কোনো প্রযুক্তিগত জ্ঞান না থাকায় প্রতিদিন প্রায় শত শত লিটার দুধ নষ্ট হয়ে যায়। খামার ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ গরু অস্ট্রেলিয়ান জাতের। এর মধ্যে কিছু গাভী ডেনমার্ক ও হল্যান্ডের জাত। প্রতি গাভী থেকে দৈনিক ১০-৩৫ কেজি পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায়।

গাভী পালনে সমস্যার কথা জানাতে গিয়ে ফার্ম মালিকরা বলেন, গোখাদ্যে কুঁড়া ভুসি, পাতা ভুসি, মুগ পাউডার, সয়াবিন খৈল ইত্যাদির দাম বেড়েছে। পাশাপাশি গো-খাদ্যে ভেজাল দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ওষুধের দামও বেড়েছে।

শাহ ছমিয়া ডেইরি ফার্মের মালিক ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ডেইরি এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও মিল্ক ভিটার পরিচালক, আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন হায়দার জানান, আমাদের সন্তানদের সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টির জন্য মাতৃ দুগ্ধের পরেই গুরুর দুধের স্থান, গরুর দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গরুর খামারকে বাস্তবমুখী পরিকল্পনার আওয়তায় আনতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এবং খামারের ব্যবস্থাপনায় আধুনিক ও সময়োপযোগী নীতিমালা প্রয়োগ করে সরকারের কাছ থেকে আমরা এই ব্যাপারে সহযোগিতার আবেদন করছি।

তিনি আরো বলেন, সরকার ভুর্তুকী এবং সহজ ও কম সুদে ব্যাংক ঋণের সুবিধা দিয়ে কৃষিখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। জনগনের সুস্বাস্থ্যের স্বার্থে পুষ্টি জোগাতে গরু-খামারের ক্ষেত্রে কৃষি খাতের মতই ভুর্তুকীসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আমাদেরকে সহযোগিতা করতে হবে।

তিনি বিদেশ থেকে আমদানীকৃত গুড়ো দুধকে বিষ আখ্যায়িত করে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আমদানীকৃত গুড়ো দুধ সিগারেটের মতই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। এই দুধে সন্তানদের আসক্ত করে জাতির স্বাস্থ্য হানি ঘটানো হচ্ছে। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টের।

সরকারের উচিত এ ব্যাপারে এখনই সর্তক হওয়া এবং সিদ্ধান্ত নেয়া। সরকারেকে ভাবতে হবে কি ভাবে গুরুর দুধের উৎপাদন বাড়ানো যায় এবং খামারগুলোকে কিভাবে পরিকল্পিত নীতিমালায় কার্যকর প্রনোদনা দেয়া যায়। তিনি এ ব্যাপারে সরকারকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের নীতিমালা প্রনয়ন কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গরুর প্রধান খাদ্য গমের ভূসি পঁত্রিশ কেজির একটি বস্তার দাম দেড় হাজার টাকা। এই দামে আমাদের দেশের গরীব মানুষেরা যে চাল খায় তার দামের চেয়েও বেশী।

যারা কৃষি পন্য উৎপাদন করে তাদের কর ছাড় দেয়া হয়। অথচ দুগ্ধ উৎপাদনকারীদের কর দিতে হচ্ছে। এটার সরকারের দ্বৈত নীতি। মিল্ক ভিটার দুধ আহরণ ক্ষেত্রেও বাঘাবাড়িতে ঔষধ পত্র ও গরুর স্বাস্থ্য সেবা বিনামূল্যে দেয়া হয়। অথচ চট্টগ্রামের দুদ্ধ উৎপাদনকারীরা সেই সেবা থেকে বঞ্চিত। আমি আমার খামার মালিকদের বলতে চাই, দুধ উৎপাদন ও বিতরণ একটি পবিত্র ব্যবসা।

উৎপাদিত দুধ প্রযুক্তির মাধ্যমে ফ্যাটমুক্ত করে বোতলজাত করার মাধ্যমে স্কুলে স্কুলে সরবরাহ ও অন্যত্র বাজারজাত করণ করা এবং দুধ থেকে মাখন, ছানা ও অন্যান্য মিষ্টান্নজাত খাদ্য উৎপাদন করে সেগুলোও বাজারজাত করা সম্ভব হলে খামার মালিকতো বটেই জাতির অনেক উপকার বয়ে আনবে।

এ জন্য তিনি খামার মালিকদের সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের আহবান জানান এবং এ ব্যাপারে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশা করেন। খামার মালিকগণ জানান, সাম্প্রতিক হাই কোর্টের দেয়া রায়ে তাদের দু’কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয় এবং বাজারজাত করতে না পারায় চার দিনে তিন হাজার লিটার দুধ ফেলে দিতে বাধ্য হয়।

সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ দু’বছর আগে দুধ প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের জন্য পটিয়ার প্রায় ৭ কানি জায়গায় উপর একটি প্লান্ট তৈরি করার ঘোষণা দেয়। ঐ ঘোষনাকে কেন্দ্র করে এখন ড্রেজারের মাধ্যমে বালি ফেলার কাজ শুরু করেছেন কতৃপক্ষ। পটিয়া ফার্ম মালিক সমিতির সেক্রেটারি নাজিম উদ্দিন হায়দার আরো জানান, মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ একটি দুগ্ধ শীতলীকরণ কারখানা স্থাপন করেছে এখানে আমি তার পরিচালক। কিন্তু মিল্ক ভিটার বড় পরিসরে একটি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কারখানা করার কথা শুনে আমরা খুবই আনন্দিত হয়েছি, পাশাপাশি খামারিরা খুবই উপকৃত হবে, অন্যদিকে চট্টগ্রামের চাহিদা মিটিয়ে এ দুধ দেশের অন্যান্য জেলায়ও সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

পটিয়ার উৎপাদিত দুধ দিয়ে বর্তমানে বৃহত্তর চট্টগ্রামের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের অভিজাত মিষ্টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফুলকলি, স্বাদ, বনফুল, জমজম, মধুবন, ওয়েল ফুডসহ প্রায় সব মিষ্টি তৈরির প্রতিষ্ঠান পটিয়ায় ডেইরি ফার্মগুলো থেকে দুধ সংগ্রহ করে। মিষ্টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে দুধ সরবরাহকারীরা জানান, তারা সকাল ও সন্ধ্যায় খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম শহরে সরবরাহ করেন। প্রতি কেজি দুধ তারা ৩৬ থেকে ৪০ টাকায় ক্রয় করে ৫০ টাকায় বিক্রি করেন। যথাসময়ে সরবরাহ করতে না পারলে প্রতিদিন কিছু দুধ নষ্ট হয়ে যায়।

ভূক্তভোগিদের দাবি , এ এলাকায় ভেটেরিনারি হাসপাতাল না থাকায় চিকিৎসকের অভাবে তারা সময়মত গরুর চিকিৎসা দিতে পারেন না। ফলে তাদের অনেক দামি গরু মারা যায়। খামার এলাকা থেকে পটিয়ার সদরের দূরত্ব বেশি হওয়ায় তারা চট্টগ্রাম শহর থেকেই ডাক্তার এনে চিকিৎসা করাতে বাধ্য হন। পটিয়ার ডেইরি শিল্প রক্ষায় জরুরী দুধ প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের প্লান্টের পাশাপাশি একটি ভেটেরিনারি হাসপাতাল সময়ের দাবী বলে জানান খামারিরা।

পশ্চিম পটিয়ায় মিল্ক ভিটার দুধ শীতলীকরণ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালিন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক।

তখন তিনি বলেছিলেন, বর্তমান সরকার সারা দেশে ৪০টি প্রকল্প স্থাপন করে দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্যোগ নিয়েছে। পশ্চিম পটিয়ার কেন্দ্রে প্রতিবার ৪০ হাজার লিটার দুধ সংরক্ষণ করা যাবে। এতে স্থানীয় দুগ্ধ খামারিরা উপকৃত হবেন। পশ্চিম পটিয়ায় প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। সংরক্ষণের অভাবে প্রতিদিন অনেক লিটার দুধ নষ্ট হয়ে আসছিল।

তৎকালিন স্থানীয় কৃষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে দেন।

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ


You cannot copy content of this page