দুদকে অভিযোগ ও ক্ষমতার অপব্যবহার..

পাহাড়সম অনিয়ম-দুর্নীতির পরও বহাল তবিয়তে নির্বাহী প্রকৌশলী!


মোহাম্মদ ফোরকান  ১৭ জুন, ২০২৩ ২:০১ : অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) একাডেমিক ভবনের লিফট ইন্সপেকশনে শুধুমাত্র স্পেন যাওয়ার কথা। তবে চট্টগ্রামের গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী এস.এম. ময়নুল হক এই যাত্রায় ভ্রমন করেছেন ফ্রান্স, ইটালী, পর্তুগাল, সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের অনেকগুলো দেশ। আর এই ভ্রমন ব্যয়ের একটি অংশ নিয়েছেন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। বাকীসব টাকা নেন চট্টগ্রাম ভিত্তিক একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান থেকে।

যদিও চমেক প্রশাসনিক ভবনের উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজের কার্যাদেশে ৮০০ কেজি ক্ষমতাসম্পন্ন জার্মানীর এলএম ব্র্যান্ডের ২টি লিফট ক্রয় ও স্থাপনের কথা। এই জন্য নোটশীটের মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছিলেন গণপূর্ত চট্টগ্রাম জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। তবে এই নির্দেশ উপেক্ষা করে তিন কোটি টাকায় নামসর্বস্ব ২টি চায়নার নকল লিফট ক্রয় করা হয়েছে। আর এতে যেকোন সময় মারাত্মক দূর্ঘটনা হয়ে প্রাণহানী হতে পারে এমন আশংকা করে লিখিত আপত্তি জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সাহেনা আক্তার।

এস.এম. ময়নুল হকের শুধু এই বিদেশ ভ্রমন বা লিফট ক্রয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ই নয়! তার বিরুদ্ধে টেন্ডারের তথ্য ফাঁস, দর-কষাকষির নামে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ঠিকাদার নিয়োগ, নিম্মমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, সংস্কার, সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের নামে ভুয়া বিল-ভাউচার করে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রাক্কলন তৈরি, টেন্ডারের শর্তানুসারে নির্ধারিত সময়ে কাজ বুঝে না নেওয়া, সরকারি অর্থ খরচ করে নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি মেরামত ও গাড়িতে সরকারি লোগো ব্যবহার এবং বেনামে চুক্তিবব্ধ হয়ে ঠিকাদারি ও সরকারি অর্থে নিজের সম্পত্তির পাহাড় গড়ার অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

জানা যায়, সরকারি বিধি উপেক্ষা করে দীর্ঘ অর্ধযুগের বেশি সময় একই চেয়ারে থাকার কারণে তাকে ঘিরে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করছে। এমন কোনো অপকর্ম নেই যা হচ্ছে না এই প্রকৌশলীর দপ্তরে। সম্প্রতি তার এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা-১ এর উপপরিচালক বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-১’র নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম ময়নুল হক বলেন, চমেকের লিফট ইন্সপেকশনে আমি যাইনি, অন্য কেউ গেছেন। আমি গেছি আরেকটায়।

চমেকের জন্য চায়না ক্রয় করার বিষয়ে এসএম ময়নুল হক বলেন, এটাও জার্মানীর। আগে দুইটা কোম্পানী ছিল, এখন এক হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, মূলত লিফট ক্রয় করার পর এক বছর বসা ছিল। ভবন প্রস্তুত না হওয়ায় সময়মতো বসানো যায়নি। তাই এই সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে।

নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতে সরকারি লোগো ব্যবহার ও সরকারি অর্থ খরচ করে মেরামত, সংস্কার ও রক্ষনাবেক্ষনের বিষয়ে বলেন, না, না এটা অফিসিয়াল গাড়ি।

দুদকে দায়েরকৃত অভিযোগে জানা জায়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একাডেমিক ভবনের নিম্মমানের লিফট ক্রয় ও স্থাপনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। সরকারি ক্রয় আইন (পিপিএ) ও সরকারি ক্রয় বিধি (পিপিআর) ভঙ্গ করে কাজ দেওয়া হয়েছে পছন্দের ঠিকাদারকে। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া মডেল মসজিদ নির্মাণে নিম্মমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে বড় অংকের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন চট্টগ্রাম গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-১ এর এই প্রকৌশলী ও সংঘবব্ধ সিন্ডিকেট।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, চমেক অধ্যক্ষের আপত্তি ও চট্টগ্রাম গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর নোটশীট কোনো কিছুই কর্ণপাত করেনি এস.এম. ময়নুল হক। উল্টো চমেক একাডেমিক ভবনে নকল লিফট স্থাপনের সুযোগ করে দিয়ে ঠিকাদার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ (ঘুষ) হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।

শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে টেন্ডার স্পেসিফিকেশন ভঙ্গ করে হাসপাতালের গাইনী অপারেশন থিয়েটার, পশ্চিম অপারেশন থিয়েটার, লেবার রুম, নিউনেটাল বেবি কেয়ার ইউনিট, কার্ডিয়াক সার্জারী ভবনসহ বিভিন্ন অপারেশন থিয়েটারে সেন্ট্রাল ডাক্ট এসি স্থাপন কাজে পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিনসহ সিডিউল স্পেসিফিকেশন ভঙ্গ করে স্থাপন করা হয়েছে স্পেসিফিকেশন বহির্ভূত এয়ারকুলার (এসি)।

চমেকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ডাক্টের সাইজ, ম্যাটেরিয়াল ও ইনশুলেশন টেন্ডার স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হয়নি। যেকোন সময় স্পর্শকাতর এসব ইউনিটে আগুন ধরে বিস্ফোরণসহ প্রাণহানী ও জান-মালের ব্যাপক ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, করোনা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে- স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ এবং স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে যত বরাদ্ধ এসেছে তা নিয়ে টেন্ডার বাণিজ্য করেছেন এসএম ময়নুল হক। এতেই ক্ষান্ত হননি তিনি। টেন্ডার পরবর্তী যে টাকা উদৃত ছিল তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার কথা। তবে তিনি তা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে কাগজে-কলমে কাজ দেখিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচার করে তা হাতিয়ে নিয়েছেন।

একাধিক সূত্র জানায়, কোন অধস্তন কর্মকর্তা তার এসব ভুয়া বিল- ভাউচার দিতে অসম্মতি জানালেই তার উপর নেমে আসে নানা হুমকি ধমকিসহ বিভিন্ন ধরণের হয়রানি। এমনকি এসএম ময়নুল ওই কর্মকর্তাকে অডিট আপত্তিতে ফাঁসিয়ে দেওয়া হুমকি দিয়ে তার অনৈতিক কাজ বাস্তবায়ন করে নেন। একইভাবে তার কোনো অনৈতিক কাজে কাউকে প্রতিবন্ধক ভাবতেই তাকে কারণ ছাড়া তিরস্কার ও শোকজ করে প্রতিষ্ঠানটিতে এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এসএম ময়নুল হক সরকারি কাজ দেখিয়ে ভুয়া ভ্রমণ সিডিউল করে অফিস ছুটি ব্যাতীত প্রতিসপ্তাহে কর্মস্থল ত্যাগ করছেন। আবার এই ভ্রমনে টিএ ডিএ খাত থেকে তুলে নিচ্ছেন হাজার হাজার টাকা। নিজের ব্যক্তিগত কারটিও বিভিন্ন সময় মেরামত করিয়েছেন গণপূর্তেও টাকায়। আবার এই গাড়িতে সরকারি স্টিকারযুক্ত লোগো লাগিয়ে তা ব্যবহার করছেন নিজের পারিবারিক কাজে। তবে তার এতসব অনিয়ম ও দুর্নীতি দেখেও ভয়ে মুখখোলার সাহস করেননি কেউই।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত চট্টগ্রাম জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, আগে এ ক্যাটাগরির লিফট দেওয়া হতো, এখন বি-ক্যাটাগরির লিফট দেওয়া হয়। তবে এটা কোন সময় কেনা হয়েছে তা খোঁজ নিয়ে যানতে হবে। আর ব্যক্তিগত কোনো গাড়ি অফিসিয়াল খরচে মেরামত, সংস্কার বা সংরক্ষণ করার কোনো সুযোগই নাই।

গণপূর্ত (আগ্রাবাদ) চট্টগ্রাম গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-১’র নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম ময়নুল হকের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে বলেন, দুদকে যদি কোনো অভিযোগ হয়ে থাকে, তা হলে এই বিষয়ে আমি কোনো কমেন্টস্ করবো না।

চট্টগ্রাম গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-১ এর অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে আওয়ামী লীগ সেভানেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া মডেল মসজিদ নির্মাণে নিম্মমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে বড় অংকের অর্থ আত্মসাতের সচিত্র প্রতিবেদন। চোখ রাখুন দৈনিক খোলা কাগজ ও সকালের-সময়-এ।

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ


You cannot copy content of this page