মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা দ্বিতীয়বারের মতো বিদেশের মাটিতে উদযাপন করলো ঈদুল আজহা। সোমবার (১২ আগস্ট) সকাল থেকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা শিবিরের প্রায় আটশো মসজিদে উৎসবমুখর পরিবেশ ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেন লাখো রোহিঙ্গা।
তারা গত দুই বছর আগেও রাখাইনে পড়তে পারেননি ঈদের নামাজ, দিতে পারেননি পশু কোরবানি। সে দেশের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী মগদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়াসহ নানা বর্বর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। এর আগে রাখাইনে বসবাসকারী এসব রোহিঙ্গাদের সবকিছু বিধি-নিষেধের উপর নির্ভর করছিল তাদের জীবন। কিন্তু, গত দুই বছর ধরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করেছেন শান্তিপূর্ণভাবে।
সহায়-সম্বল কিছু রোহিঙ্গা নিজ উদ্যোগে পশু কোরবানি দিয়েছেন। যারা দিতে পারেননি তাদের সরকার ও এনজিও’র পক্ষ থেকে বিতরণ করা হয়েছে কোরবানির মাংস। উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করা হয়েছে। এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন অধিকাংশ ইমাম ও মুসল্লি। মসজিদগুলোতে মোনাজাতে অংশ নেয় হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও মর্যাদার সাথে রাখাইনে যেন তারা ফিরে যেতে পারে তা মোনাজাতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়।
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ ইউনুছ আরমান বলেন, এই বছর ঈদুল আজহার দিনে আমি নিজ উদ্যোগের একটি গরু কোরবানি দিয়েছি। নিজের বাড়ির জন্য কিছু মাংস রেখে অবশিষ্ট মাংস আমার প্রতিবেশীদের ভাগ করে দিয়েছি। কারণ, এই বছর এনজিও’রা কোরবানির মাংস বিতরণ কম করেছে। বিশেষ করে নিবন্ধিত ক্যাম্পগুলোতে মোটেও দেয়া হয়নি।
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আয়ুব আলী মাঝি বলেন, দ্বিতীয় বছরের মতো অন্তত ঈদুল আজহার নামাজটি আদায় করার সুযোগ হয়েছে। আজকে ঈদের নামাজ শেষে শুধু ইমাম, মৌলভীরা নয়, মসজিদে উপস্থিত কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। রাখাইনে আমরা কেউ বাবা-মা, বোনকে হারিয়েছি, আবার কেউ ভাই ও স্বজনকে হারিয়েছি। কবরে পড়ে রয়েছে আমার মা।
নিজে কোনো পশু কোরবানি দিতে না পারলেও অন্তত তাদের জন্য ফাতেহা ও নামাজ তো আদায় করতে পেরেছি। উখিয়ার কুতুপালং টিভি টাওয়ার সংলগ্ন বটতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, এই বছর তেমন কোনো মাংস বিতরণ হয়নি। অবশ্য, যেটুকু পেয়েছি, অন্তত আমার ব্লকের সব রোহিঙ্গা পরিবারকে ভাগ করে দিতে পেরেছি। এরপরও রাখাইনের চেয়ে এই রোহিঙ্গা ঝুপড়িতে আমরা শান্তিতে রয়েছি।
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মোহাম্মদ লালু মাঝি বলেন, ‘রাখাইনে নির্যাতনের শিকার হলেও নিজ দেশের জন্য মায়া হয় আমাদের। আমরা চাই নিরাপদে রাখাইনে ফিরে যেতে। আজকে ঈদ জামায়াত শেষে আল্লাহর কাছে এই ছিল প্রার্থনা। কারণ, এই ছোট পরিসর আমাদের কাছে বিষাদের হয়ে উঠেছে। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। নেই আনন্দ উপভোগ করার কোনো অবস্থা।
সকালে ঈদের নামাজ আদায় করার সময় কোনো বৃষ্টি ছিল না। এজন্য রোহিঙ্গাদের একত্রে নামাজ আদায় করতে কোনো সমস্যা হয়নি। নামাজ শেষে ঈদের জন্য বিতরণ করা পশুগুলো জবাই করা হয়। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম জানান, এ বছর কোরবানির ঈদে এক লাখ ২০ হাজার পরিবারের মধ্যে কোরবানির পশুর মাংস বিতরণ করা হয়েছে। প্রত্যেক পরিবারকে দুই কেজি করে এসব মাংস বিতরণ করা হয়। এতে অন্তত ৫ হাজার পশু জবাই করে রোহিঙ্গাদের মাঝে মাংস বণ্টন করা হয়েছে। সরকার ও এনজিওরা মিলে এসব পশু কোরবানি দে্ওয়া হয়েছে। একইভাবে স্থানীয়দের মাঝেও কোরবানির পশু বিতরণ করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, এ বছর কোরবানির ঈদে রোহিঙ্গাদের মধ্যে যথাসম্ভব মাংস বিতরণ করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ছাড়াও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত বিভিন্ন এনজিও, সংগঠন থেকে ও ব্যক্তিগতভাবেও কোরবানির পশু দান করা হয়েছে।