চট্টগ্রাম এলএ শাখা ঘিরে লুটপাট, দালাল চক্রের ফাঁদে ভূমির মালিকরা


৩১ জানুয়ারি, ২০১৯ ৪:৪৩ : অপরাহ্ণ

সকালেরসময় রিপোর্ট:: ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ পেতে দালাল ধরবেন না, প্রতারিত হবেন না এই লেখাটি দেয়ালে লেখা থাকলেও বাস্তবে কোন কার্যকর নেই বললেই চলে। হরি লুট চলছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখায়। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জিম্মি করে লুটপাটের এ মহোৎসবে মেতে উঠেছেন কানুনগো, সার্ভেয়ার থেকে শুরু করে কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এছাড়া লুটপাটের অংশীদার হিসেবে বহিরাগতদের নিয়ে এলএ শাখার কর্মকর্তারা তৈরি করেছেন সংঘবদ্ধ দালাল চক্র। এলএ শাখা ঘিরে ভূক্তভোগীদের অভিযোগ রয়েছে অহরহ, বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব বিষয় জেনেও নাজানার মতো রহস্যজনকভাবে নিরব ভূমিকা পালন করে আসছেন।

এলএ শাখার সকল প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহনের জন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়া এখন নিত্যদিনের অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। ঘুষ নাদিলে ফাইল নড়ে না এখানে, প্রতি টেবিলে টেবিলে আলোচনার ঝড় উঠে ঘুষ বানিজ্য নিয়ে, অভিযোগ আছে সার্ভিয়ারদের মাধ্যমেই ভূমি মালিকদের নাম ঠিকানা দালালদের দেওয়া হয়, এছাড়া স্বচ্ছতা আনতে লোক দেখানো এলএ শাখায় বসানো হয়েছে ছয়টি সিসি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। তার পরও ঐখানে দালালদের তৎপরতা দেখা যায় চোখেঁ পড়ার মত।

সূত্র জানায়, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ভূমির অবকাঠামোগত অবস্থান নির্ণয়ের জরিপ, জমি অধিগ্রহণের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের জমির মূল্য নির্ধারণ এবং চেক প্রদানের সময়ই মূলত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লুটপাটে জড়িয়ে পড়েন। অহেতুক হয়রানি করা হয় ক্ষতিগ্রস্তদের, এ থেকে পরিত্রাণ পেতেই অনেকেই তাদের উৎকোচ দিতে বাধ্য করা হয়। উৎকোচ না দিলে ভিবিন্ন মামলায় ফাইল আটকে দেওয়া হয়। এলএ শাখার অধীনে এসব হরিলুটের জন্য কাজ করে শক্তিশালী কয়েকটি সিন্ডিকেট। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মোটা অংকের ভাগ দিয়ে এসব কাজ করেন দালাল ও সার্ভেয়াররা।

অভিযোগ রয়েছে, চায়না অর্থনীতি জোন, কর্ণফুলী টানেল, আউটার রিং রোড প্রকল্প, মেরিনার্স সড়ক, কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ ও বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে চেক বিতরণের নামে সিন্ডিকেটগুলো কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

এর আগে ৫৮ লাখ টাকাসহ এক ব্যক্তি গ্রেফতার হন এলএ শাখা অফিসের নিচে । তখন টনক নড়ে প্রশাসনের। ঘটনার পর তখন ৩ দিনে এলএ শাখার ১০জন সার্ভেয়ার ও ২জন কানুনগো সহ তখনকার ভূমি হকুম দখল কর্মকর্তা (ইউনিট-১) মোহাম্মদ তফাজ্জল হোসেনকে ও বদলি করা হয়।তারপরে এক সার্ভেয়ারের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা লুটের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে এলএ শাখায় বড় ধরনের লেনদেনের প্রমাণ পায় পুলিশ।

এলএ শাখার দুর্নীতিবাজদের গড়ে তোলা আলোচিত সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক হিসেবে এখন বরাবরেই নাম উঠে আসছে আনোয়ারা বৈরাগ মুহাম্মদ পুর গ্রামের ভেন্ডার (স্ট্যাম) মোজাফফর আহম্মদের ছেলে ছাত্র দল ক্যাডার ইকবাল হায়দারের নাম । এবং ইকবালের
সাথে তার খালাত ভাই এলএ শাখার কম্পিউটার অপারেটর কাম অফিস সহকারী মো. রিয়াজ জড়িত বলে খবর পাওয়া গেছে । তারা চায়না অর্থনীতি জোনের সাবেক সার্ভিয়ার মো. আরিফ ও সাহাবউদ্দীনকে নিয়ে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ করা জমির মূল্য নির্ধারণ ও চেক বিতরণের উৎকোচ হিসেবে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন বলেও জানান ভূমির মালিকরা।

এর পর বিষয়টি সর্ব মহলে জানা জানি হলে তখন ঔ দুই সার্ভিয়ারকে বদলি করা হয়। বর্তমানে সার্ভিয়ার মো.মোমিনকে সাথে নিয়ে ইকবাল তার একতলা বিল্ডিংকে রাতারাতি কাটদিয়ে তিনতলা বিল্ডিং করে সরকার থেকে ক্ষতি পুরণের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পায়তারা করছেন বলেও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এর আগে বর্তমান ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জান চৌধুরী জাবেদ সারপ্রাইজ ভিজিটে যান এলএ শাখায়। তখন মন্ত্রী এক দালালকে পাকড়াও করে তাৎখনিক শাস্তি দিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ, তিন কর্মচারীকে স্ট্যান্ড রিলিসে নির্দেশ দেন। মন্ত্রী এ সময় ইকবালকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। এর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে দ্রুত চলে যান ইকবাল। পরদিন এ বিষয়ে স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদ পত্রিকা সমুহে ফলাও করে সংবাদ চাপা হয়।

এলএ শাখায় তার যাতায়াত নিষিদ্ধ হলেও বর্তমানে অবাধে যাতায়াত করছেন ইকবাল হায়দার। ছাত্র দলের এ ক্যাডার স্বদলবল নিয়ে জিম্মি করে ফেলেছে পুরু এলএ শাখা। জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) দুদক, ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমুহকে বিষয়টি অবগত করা গেলেও বরাবরই রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছে তারা।

ক্ষতিগ্রস্ত কিছু ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, এ ইকবাল হায়দার ও কয়েকজন সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত উর্ধতন কর্মকর্তাদের ভূক্তভোগিরা অভিযোগ দিয়ে আসলেও কৃর্তপক্ষ এখনো কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি এই সেন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন প্রকল্পে যৌথ তদন্তের নামে ইকবাল হায়দার লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। জমি ও ঘর বাড়ির মূল্য নির্ধারণ এবং জমির রেকর্ড সংশোধনের নামেও টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই সেন্ডিকেট।

অভিযোগকারীরা বলেন, দালাল ও সার্ভিয়াররা ধমক দিয়ে আমাদের বলেন, জমির সঠিক মূল্য পেতে হলে তাদের শতকরা ১০/১৫ পারসেন্টিস দিতে হবে। তা না হলে জমির মূল্য অর্ধেক হয়ে যাবে এবং ক্ষতিপূরণের এলএ শাখার চেক গ্রহণ করার সময় ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ ঘুষ দিতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের থেকে আগাম ঘুষের টাকা বাবদ অগ্রিম চেক নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান।

সূত্র আরো জানায়, মোহাম্মদ ইকবাল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাধে দীর্ঘদিন ধরে এলএ শাখায় ঘুষ বাণিজ্য চালিয়ে আসছেন। অভিযোগ রয়েছে, এলএ শাখায় তার প্রভাবের কাছে অনেকটাই দিশেহারা ভূমি হকুম কর্মকর্তারা।

শুধু কর্ণফুলী টানেল নই, ইকবাল হায়দারের সেন্ডিকেট সব প্রকল্পেই হাত বাড়িয়ে রেখেছে যেমন: চায়না অর্থনীতি জোন, কর্ণফুলী টানেল, চিটাগাং সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্প, চট্টগ্রাম সড়ক চার লেন প্রকল্প, চাকতাই খাল মেরিনার্স বাইপাস সড়ক নির্মাণ প্রকল্প, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন-এর সড়ক প্রকল্প, দক্ষিণ পতেঙ্গা সড়ক নির্মাণ প্রকল্প, চট্টগ্রাম সেনানিবাস সম্প্রসারণ প্রকল্প, বহদ্দারহাট হতে কর্ণফুলী সেতুর অ্যাপ্রোচ জয়েন্ট চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প, কর্ণফুলী উপজেলা প্রকল্প, ও নতুন রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প।

এ বিষয়ে, বর্তমান (ভূমি হকুম কর্মকর্তা ১) আসিফ ইমতিয়াজ বলেন , এলএ শাখাকে ঘিরে কয়েকটি দালাল চক্র লোকজনকে হয়রানি করে আসছে এটা ঠিক। কিন্তু আমাদেরও কিছু সার্ভেয়ার ও কানুনগো এসব কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ পেয়েছি। এই অভিযোগের কারণে তিন জন সার্ভেয়ারকে উপজেলায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর কেউও যদি দালালের আশ্রয় নেয় সেক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি? কার্যালয়ে চেক দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আসিফ ইমতিয়াজ আরো বলেন, এলএ শাখার একেকটা প্রকল্প একেক জায়গায় হওয়ায় বেশিরভাগ সময় প্রকল্প এলাকায় গিয়ে ক্ষতিপূরণের চেক দেওয়া সম্ভব হয় না। কেন সম্ভব নই জানতে চাইলে বলেন, এলএ শাখার অফিসে চেক বিতরণের প্রচলিত নিয়ম ত্রুটিপূর্ণ তা আমি জানি। কারণ চেক বিতরণ করতে গেলে এমপি মন্ত্রীর প্রয়োজন হয় সেই ঝামেলা থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্যই অফিসে চেক দেওয়া হয় বলেও মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা। কিন্তু এই কর্মকর্তার ব্যাপারেও দুর্নীতির দায়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিল ভূূূমির ক্ষতিগ্রস্ত মালিকরা।

চেক বিতরণে অনিয়মে ভূমি ম্যানুয়েল অধ্যাদেশ ১৯৯৭ এর ৪৯(ক) ধারায় জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের যথাসম্ভব প্রকল্প এলাকায় এলএ চেক বিতরণ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামে প্রকল্প এলাকার পরিবর্তে বেশিরভাগ সময়ই এলএ শাখার অফিসে চেক বিতরণ করা হচ্ছে বলে সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে দুদক পরিচালক বলেন, এল এ শাখার দুর্নীতির ব্যাপারে আমরা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি। এলএ শাখার ব্যপারে আমাদের কাছে এখন ৩টি মামলা আছে। পেপার কাটিং সহ ভূক্তভোগিদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে উর্ধতন কৃর্তপক্ষের সাথে আলোচনা করে যে কোন মুহুর্তে অভিযানে যাব।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভুমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেন, আমি সবসময় সারপ্রাইজ ভিজিট করি। এই মেসেজটা, মাঠ পর্যায়ে চলে গেছে। মেসেজটা কি? এখানে নতুন কেউ আসেনি। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ওরা’ আমাকে ভালো করে চেনে। সুতরাং যাদের সমস্যা আছে তাদেরকে বলব ভালো হয়ে যেতে, আর না হয় অন্য জায়গায় চলে যেতে। সকল ভূমি অফিস সিসিটিভির আওতায় থাকবে এবং আমাদের একসেস থাকবে। অফিসে বসেই ভূমি অফিসের চিত্র দেখব। তারপরও ভূমি অফিসে মানুষের হয়রানি বন্ধ না হওয়াকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন মন্ত্রী। অবভিয়াসলি চ্যালেঞ্জ অটোমেশন।

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ