বিষয় :

কিংবদন্তি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদ মারা গেছেন


বিনোদন ডেস্ক  ১৪ মার্চ, ২০২৪ ১২:১১ : পূর্বাহ্ণ

না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন কিংবদন্তি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদ। বুধবার (১৩ মার্চ) সন্ধ্যার পর তিনি স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেন। বাংলা ট্রিবিউনকে এমনটাই জানান কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী ও শিল্পীর পারিবারিক বন্ধু শামীম আরা নীপা।

এমন মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে নীপা বলেন, ‘ওনার মা মারা যাওয়ার পর থেকেই একটা ট্রমার মধ্যে চলে যান। ঠিক স্বাভাবিক ছিলেন না মানসিকভাবে। মা হারানোর বেদনা সম্ভবত তিনি নিতে পারেননি। এভাবেই চলছিল। বুধবার রোজা রাখলেন। ইফতারও করলেন। এরপরই তিনি নীরবে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে করছি।

এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতলের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. স্বাগতিক লোহানী বলেছেন, তার গলায় দাগ পাওয়া গেছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে নিজ কক্ষ থেকে তাকে উদ্ধার করেন পরিবারের সদস্যরা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাসপাতালে আনা হলে আমরা তাকে মৃত পাই। প্রাথমিক সিদ্ধান্তে আমরা এটাকে আত্মহত্যা হিসেবে মনে করছি। পরিবারের সদস্যরা তাকে নিজ কক্ষে ঝুলন্ত অবস্থায় পেয়েছেন বলেও জানান এই চিকিৎসক।

সাদি মহম্মদের ব্যক্তিগত সহকারী জানান, বেগুনি-মুড়ি দিয়ে ইফতার শেষে নিজ রুমে যান তিনি। বেশ কিছুক্ষণ রেয়াজ করেন তানপুরা নিয়ে। যেটা তিনি প্রায় সময় করে থাকেন। এরপর অনেক সময় চুপচাপ থাকেন। এ সময় পরিবারের সদস্যরা ডাকাডাকি করলে সাড়া মিলছিল না। তারা গিয়ে দেখেন দরজা বন্ধ। পরে দরজা ভেঙে সাদিকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেন তারা।

সাদি মহম্মদের মৃত্যুর খবর পেয়ে হাপাতালে ছুটে এসেছেন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শুভাকাঙ্ক্ষীরা। পরিবারের সদস্যরা জানান, তাদের পরিবারের কিছু সদস্য বিদেশে অবস্থান করছেন। সবার সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

হাসপাতালে ছুটে এসেছেন অভিনেতা ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, সাদি ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে আমি এক কথায়- বিধ্বস্ত। ১৯৬৮ সাল থেকে ওনাদের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক। তিনি এত ভালো মানুষ ছিলেন যে রাগ করেও কাউকে কিছু বলেছেন- এমনটা কখনোই দেখিনি। এত বড় একজন শিল্পী, কিন্তু তার মধ্যে কোনও অহমিকা ছিল না। তিনি আজ চলে গেলেন। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করি।

প্রসঙ্গত, সাদি মহম্মদের মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ (৯৬) গত বছরের ৮ জুলাই বার্ধক্যজনিত রোগে মারা গেছেন। মায়ের মৃত্যুর দিন সাদি মহম্মদ বলেছিলেন, মা গত ১৫ বছর ধরে হুইল চেয়ারে বসেই স্বাভাবিক জীবন পার করছিলেন। দিনমান চেয়ারে বসেই ছুটে বেড়াতেন। তবে কিছু জটিলতা তৈরি হওয়ায় চারদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করি। মা তো আর ফিরলেন না। চেয়ারে আর বসলেন না। জানেন, ৭১ সালের ২৬ মার্চ বাবাকে যখন পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে, তখন আমার এই মায়ের কোলে ছিল ১০টি সন্তান।

এই মা আমাদের ১০ ভাই-বোনকে একা মানুষ করেছেন। সেলাই মেশিন চালিয়ে আমাদের ভাত খাইয়েছেন, পড়াশোনা করিয়েছেন। এই মা ছিল আমার কাছে অন্তহীন আকাশ। যে আকাশে আমি পাখা মেলে দিতাম পাখির মতো। সেই আকাশটা আজ থেকে আর নেই।

সাদি মহম্মদ সেদিন আরও জানান, তার মা ৭১ সালের ২৬ মার্চের সেই ভয়াল রাতে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়েন। সেদিন থেকে দুটো পা ভেঙে অকেজো হয়। এরপর লম্বা সময় ক্র্যাচ এবং শেষ ১৫ বছর হুইলচেয়ারে জীবন কাটিয়েছেন, একই বাড়িতে। সেই মাকে হারানোর ব্যথা বুকে চেপেই একই বাড়িতেই বেছে নেন স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ।

সাদি মহম্মদ রবীন্দ্রসংগীতের ওপরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি একজন কিংবদন্তি শিল্পী ও সুরকার। রবীন্দ্রসংগীতে তার মূল পরিচিতি গড়ে উঠলেও আধুনিক গানেও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

অসংখ্য রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে তার কণ্ঠে। সঙ্গে আধুনিক গানও। এছাড়াও তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠন রবিরাগের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১২ সালে তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে চ্যানেল আই। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তার বাবা সলিমউল্লাহকে হত্যা করে। তার বাবার নামে ঢাকার মোহাম্মদপুরে সলিমউল্লাহ রোডের নামকরণ করা হয়েছে। সাদি মহম্মদের ভাই শিবলী মহম্মদ বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী।

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ