এমএলএম এমটিএফই'র ফাঁদ

১০০ কোটি ডলার হাতিয়ে ওমরায় গেলেন দুই প্রতারক!


নিজস্ব প্রতিবেদক ২৫ আগস্ট, ২০২৩ ১১:২৯ : পূর্বাহ্ণ

অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে দুবাইভিত্তিক মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম মডেলের প্রতিষ্ঠান মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) অবৈধ ক্রিপ্টো কারেন্সির (বিট কয়েন) মাধ্যমে অন্তত ১০০ কোটি ডলার প্রতারণা করেছে।

এই এমএলএম কোম্পানির বিরুদ্ধে মাত্র ছয় মাস ভার্চুয়ালি ব্যবসা করে সারা দেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা প্রতারণা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমটিএফইর ফাঁদে পা দিয়ে দেশের প্রায় ৮ লাখ মানুষ হাজার কোটি টাকা হারিয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এমটিএফই’র প্রতারণা ও দুদকের ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ দিলে তাহলে আইন অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়ে থাকলে খতিয়ে দেখা হবে, ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এমটিএফই প্রতারণা নিয়ে দুদকের বাড়তি নজরের বিষয়টি আগেও জানা গিয়েছিল। গত ১৯ আগস্ট জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এমটিএফইর মতো উচ্চ প্রযুক্তির দুর্নীতি শনাক্ত ও প্রতিরোধে সহযোগিতা চেয়েছিল দুদক।

এমটিএফই অ্যাপস দুবাই ভিত্তিক একটি অনলাইন প্রতিষ্ঠান। এটি অনলাইনে বাংলাদেশে ডেসটিনির মতো এমএলএম ব্যবসা শুরু করেছিল। এই প্রতিষ্ঠান সারা বাংলাদেশে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ও সিইও নিয়োগ দিয়েছিল। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটির শতাধিক সিইওর (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) ভার্চুয়ালি অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে।

সারা দেশে এই সিইওদের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ অল্প সময়ে অধিক মুনাফার লোভে পড়ে টাকা দিয়েছে। সিইওরা এই টাকায় ডলারের মাধ্যমে বিট কয়েন ক্রয় করে তাদের অ্যাকাউন্টগুলোতে ট্রান্সফার করে নেয়। এরই মধ্যে গত ১৬ আগস্টের পর হঠাৎ করে এমটিএফই-এর ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তখন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে যে তারা প্রতারিত হয়েছে। শতাধিক সিইওর মধ্যে ৫০ জন সিইওর ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্টে ৮ কোটি ১৫ লাখ ডলার জমা হওয়ার তথ্য পেয়েছে সিআইডি। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯০০ কোটি টাকা হয়।

প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা জানান, উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম মডেলে ব্যবসা করত এমটিএফই। এখানে বিনিয়োগকারীদের একটি অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। বিনিয়োগকারী যার মাধ্যমে বিনিয়োগ করবেন তিনিও এর কমিশন পাবেন। কারও অধীনে ১০০ বিনিয়োগকারী থাকলে তিনি ‘সিইও’ হিসেবে গণ্য হবেন। মূলত ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (যেমন বিটকয়েন) বিনিয়োগ করতে হয়। যদিও ক্রিপ্টো ট্রেডিং বাংলাদেশে নিষিদ্ধ।

বিনিয়োগকারী বেশ কয়েক জনের তথ্যমতে, টিম লিডাররা বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে শুরুতে গ্রাহকদের তিন হাজার টাকায় এমটিএফই প্ল্যাটফর্মে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে দিত। প্রতিটি অ্যাকাউন্টে ‘রেফার’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে টিম লিডারের হিসাব বা আইডি নম্বর। পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগকারীরা এই অ্যাপে ডলার জমা করতেন।

তারা জানান, এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন দুই হাজার টাকা করে লাভ পাওয়া যাবে। এই ফাঁদে পড়েই অনেকে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু সম্প্রতি বিনিয়োগকারীরা টাকা তুলতে পারছিলেন না, তখন বলা হয় সফটওয়্যার আপডেটের কথা। হঠাৎ করেই বিনিয়োগকারীদের অ্যাপের অ্যাকাউন্টে জমা থাকা ডলারের বিপরীতে সমপরিমাণ দেনা দেখাতে থাকে। তারা নিজেদের অ্যাকাউন্টে ঢুকতে পারছিলেন না। পরে অ্যাপটি উধাও হয়ে যায়।

এদিকে এমটিএফই’র কাছে প্রতারিত হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি মামলা করেছেন প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা। এরই মধ্যে এমটিএফই অ্যাপ ব্যবহার করে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে এক মামলায় রাজশাহী থেকে দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রতারণা করে আলোচিত এমটিএফই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় শেয়ার, ডলার, ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচার কানাডা ও দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বলে দাবি করত।

মূলত প্লে-স্টোর ও অ্যাপস্টোর থেকে অ্যাপ নামিয়ে তাদের সদস্য হতে হয়। এ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা দুবাই প্রবাসী বাংলাদেশি মাসুদ আল ইসলাম। শুরুতে অন্তত ২৬ ডলার বা সমপরিমাণের টাকা বিনিয়োগ করতে হতো এ প্রতিষ্ঠানে। মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে এই টাকা জমা দেয়া যেত।

সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের তদন্ত শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার বাছির উদ্দিন বলেন, রাজশাহী, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় প্রতারণার তথ্য আমরা পেয়েছি। ইতোমধ্যে রাজশাহীতে একটি মামলাও হয়েছে। সেটি পিবিআই তদন্ত করছে। তবে আমরা সারা দেশে এমটিএফই-এর শতাধিক সিইওকে খুঁজছি।

এদের মধ্যে ৫০ জনের নামের তালিকা ও তাদের ভার্চুয়ালি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ডলার থাকার তথ্য পেয়েছি। সেসব ডলার হয়তো ক্রিপ্টোকারেন্সি। তা হয়তো আগেই পাচার হয়ে যেতে পারে। তবে আগে আমরা এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি। এরপর তদন্তে নামবো।

সকালের-সময়/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ