রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণ ও সংস্কার কাজে অনিয়ম


নিজস্ব প্রতিবেদক ১৬ আগস্ট, ২০২৩ ৬:০০ : অপরাহ্ণ

ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে পর্যটন শহর কক্সবাজারে রেল যাওয়ার কথা আগামী সেপ্টেম্বরে। কিন্তু বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারমুখী নির্মাণাধীন রেলপথের প্রায় ১০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্রিটিশ আমলে তৈরি রেললাইন বাঁকা হওয়ার কোনো খবর পাওয়া না গেলেও নতুন তৈরি করা লাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনায় প্রকল্পের নির্মাণ কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণকাজ করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। দেশীয় প্রভাবশালী এ দুটি প্রতিষ্ঠানই রেলওয়ের বেশির ভাগ বড় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

আর এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পরপর দুবার রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে পাশাপাশি দুটি লাইন থাকলেও দুবারই ঢাকামুখী রেললাইনটি বেঁকে যাওয়ায় রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই রেশ কাটতে, না কাটতেই কয়েক দিন আগে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে নির্মাণাধীন রেললাইনের একটি অংশের পাথর ও মাটি ভেসে গেছে। পাশাপাশি রেললাইন উঁচু-নিচু ও বাঁকা হয়ে গেছে। এতে রেলপথ নির্মাণ ও সংস্কারে অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্পের নকশায় ত্রুটির কারণে পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় কক্সবাজারের রেলপথ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা ছাড়া তত্ত্বাবধান, রক্ষণাবেক্ষণ ও সঠিক উপকরণ সঠিকভাবে ব্যবহার না করার কারণে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ-এর ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে পানি প্রবাহের বিপরীত মুখে। শুধু মাটি উঁচু করে রেলপথ বানানো হয়েছে এবং পানি যাওয়ার পর্যাপ্ত পথ রাখা হয়নি। এ প্রকল্পের বিশদ নকশায়ও ভুল আছে।

নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, সড়ক কিংবা রেলের এ ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প চূড়ান্তকরণের আগে প্রতিবেশ ও পরিবেশগত দিক ভেবে দেখা উচিত, যাতে ভবিষ্যৎ বা নিকটভবিষ্যতে কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হয়। কিন্তু দৃশ্যত মনে হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও আখাউড়া রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে তেমনটি ভাবা হয়নি। রেলপথ নির্মাণের আগে যথাযথভাবে মাটি পরীক্ষা করা হয়নি। ট্রেনের মতো অত্যন্ত ভারী ও দ্রুতগামী বাহন চলাচলের উপযোগী করা হয়নি।

বরং এই রেলপথের নিচে থাকা খালসহ অন্যান্য জলাভূমি ঢালাওভাবে ভরাট করা হয়েছে। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক খালগুলোর ওপর সেতু, কালভার্ট ও সুইসগেট নির্মাণ না করায় পানিপ্রবাহের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রেললাইন দেবে যাচ্ছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অতি উৎসাহী কিছু লোকের অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ এবং অপরিকল্পিত ভাবনা-চিন্তার কারণেই এমন বিপর্যয় হয়ে থাকে বলে মন্তব্য করেন আশীষ কুমার দে।

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণে প্রকল্প পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিল মন্তব্য করে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের নিয়ম মানার জন্যই হয়তো নামমাত্র সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। ভালোভাবে, সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হলে এই সমস্যা হয়তো আগেই চিহ্নিত করা যেত।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামের দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইনে ছোট ছোট কালভার্ট রাখা হয়েছে, যা পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এ রুটের বিভিন্ন জায়গায় মাটি ভরাট করে বাঁধ না দিয়ে রেলপথ খুঁটির ওপর করা উচিত ছিল। রেললাইন বেঁকে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ ও সঠিক উপকরণ সঠিকভাবে ব্যবহার না করার কারণেই রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

নিয়ম হচ্ছে রেলের স্লিপার কংক্রিটের হতে হবে এবং নিচের পাথর ঠিকঠাক থাকতে হবে, রেলকে স্লিপারের সঙ্গে যুক্ত রাখার উপকরণ সঠিক হতে হওয়ার পাশাপাশি সঠিক নিয়মে ব্যবহার করতে হবে। এটা করা না হলে রেললাইন বেঁকে যেতে পারে। শুধু তাপমাত্রার কারণে রেললাইন বাঁকে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান জানিয়েছেন, সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করেই রেলওয়ের সব প্রকল্প নেওয়া হয়। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পও সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করে নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে মাত্র দুই থেকে তিন কিলোমিটার ক্ষতি হয়েছে। রেললাইন বেঁকে গেছে বলা হচ্ছে। আসলে এটা ঠিক নয়, ভুলভাবে এমনটা বলা হচ্ছে। কারণ লাইনের সব জায়গায় এখনো ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শেষ না হওয়ায় কিছু জায়গায় ডিসপ্লেস হয়েছে। এটাকে বেঁকে যাওয়া বলে না।

এসএস/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ