বেপরোয়া রেকর্ড কিপার ‘অঞ্জনা সেনের’ লাগাম টানবে কে?


মোহাম্মদ ফোরকান  ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২ ৯:১৫ : অপরাহ্ণ

বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিকদের বাড়ি-ভিটা, জমি-জমার যাবতীয় দলিল দস্তাবেজ সংরক্ষণের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স। আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স সারাদেশে অবস্থিত। কিন্তু চট্টগ্রামে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের রেকর্ড কিপার ‘অঞ্জনা সেন’ ও তার কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে দলিল জালিয়াতি, সূচি বইয়ে নাম পরিবর্তনসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা যায়, চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রারের নিয়ন্ত্রণাধীন একজন সাব-রেজিস্ট্রার, রেকর্ড কিপার, সহকারী রেকর্ড কিপার ও দুইজন পিয়ন নিয়ে প্রশাসনিক কাঠামোয় গঠিত এ প্রতিষ্ঠান। বর্তমান রেকর্ড কিপার অঞ্জনা সেন সহকারী হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে রেকর্ড কিপার হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। সরকারী চাকুরী বিধি অনুযায়ী তিন বছর পর পর বদলির নিয়ম থাকলেও অদৃশ্য কারণে ‘অঞ্জনা সেন’ বদলি হয় না। উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তিনি দীর্ঘদিন বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

সকালের-সময় ডটকমের হাতে কিছু দলিল (নকল কপি) আসে, যেখানে দেখা যায় রেকর্ড কিপার অঞ্জনা সেন নিজের হাতেই সম্পূর্ণ দলিলটি লিখেছেন। সেখানে দেখা যায় হাটহাজারী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ১৯৪০ সালের নিলাম হওয়া দক্ষিণ পাহাড়তলী মৌজার উক্ত সনের ৭নং বালামের ২০৫-২০৬ নং পৃষ্ঠায় লিপিকৃত ১৪৩নং এস/সি দলিল, যাহা বালামের সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক ও মিল নেই। সম্পূর্ণ জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে উক্ত জাল (নকল) দলিল তৈরি করে একটি পক্ষকে প্রদান করেছেন।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বোয়ালখালী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ১৯৭৬ সালের ৬৩৩ নং দলিলের বালামে দাগ খতিয়ান পরিবর্তন করে নকল দলিল সরবরাহ করার দুইদিন পর উক্ত বালাম থেকে অদ্যাবধি আর কোন নকল সরবরাহ করা হচ্ছে না। উক্ত দলিলের জন্য দরখাস্ত করা হলেও নকল দেওয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীকে।

সম্প্রতি পাঁচলাইশ সাকিনের সাইফুল ইসলাম নামিয় এক ব্যক্তি রেকর্ড কিপার এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে মহাপরিদর্শক নিবন্ধন ঢাকা বরাবরে একটি অভিযোগ করেছেন, যাহাতে দেখা যায় ১৯৫২ইং সনের সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ৫০৬৪নং একটি জাল দলিল রেকর্ড কিপার ‘অঞ্জনা সেন’ নিজ হাতে তৈরি করে সাইফুল ইসলাম গং কে পথের ভিখারী বানিয়ে দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে আরও দেখা যায় উক্ত দলিলটি প্রকৃতপক্ষে ভুয়া ও সম্পূর্ণ (নকল) জাল। রেকর্ড পত্রের সাথে উক্ত দলিলের কোন মিল নেই। এ বিষয়ে সাইফুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের শত শত অভিযোগ অঞ্জনা’র বিরুদ্ধে দেওয়ার পরও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয় নাই।

অনুরূপভাবে ফটিকছড়ি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ১৯৯৬সালের ২১৫৬নং দলিলটি রেকর্ডরুম এর নকল নবিশ “বাবুল কুমার দে” মূল বালাম ও সূচি বই এ জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করে নকল দেওয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ার পর অপর নকল নবীশ সুমন মিত্র এর মধ্যস্থতায় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে উক্ত রেকর্ড কিপার বাবুল কুমার দে নামক নকল নবিশকে ছেড়ে দেন বলে সূত্রে জানা গেছে।

সেই সুবাদে তাহার অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, কর্মজীবনে বেশিরভাগ সময় রেকর্ড কিপার অঞ্জনা সেন রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে চাকরি করার সুবাদে বিভিন্ন কর্মকর্তা কর্মচারীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলে নানান অপকর্ম, অনিয়ম- দুর্নীতি করার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। রেকর্ড কিপার অঞ্জনা’র এ সকল অপকর্ম ও অনৈতিক সম্পর্কের কথা চট্টগ্রাম রেজিস্ট্রেশন বিভাগে সকলের মুখে মুখে এবং সকলেই এই বিষয়ে অবগত।

সংশ্লিষ্ট অফিস সূত্রে জানা যায়– অঞ্জনা সেনের রেকর্ড কিপার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর রেকর্ডরুমে সি,সি ক্যামেরা বসানো হয়, কিন্তু তাহার রুমে কৌশলে ক্যামেরা লাগানো হয়নি। এবং এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে করোনা কালিন সময়ে যখন সরকারি প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, সেই বন্ধের দিনেও অফিসে এসে তার বিশ্বস্ত সহযোগী সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নকল নবিশ জয়দেব পাল- বিপ্লবকে নিয়ে নানান অপকর্ম করেন, যেমন- বালামে দাগ পরিবর্তন, ঘষামাজা, বালাম ও সূচি বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলার মতো অপকর্ম করেছেন ও বর্তমানেও এসব করে যাচ্ছেন বলে দীর্ঘ সূত্রে জানা গেছে।

সম্প্রতি সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ১৯৬৩ সালের ৭০৩ নং দলিলের মুল বালামের ১ নং সূচী বইতে নাছির উদ্দিন ও নজির আহম্মদ নামক ব্যক্তিদের নামে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে একটি দলিলের সূচী লিপিবদ্ধ করেন, জয়দেব পাল যার লিখক ।

সরেজমিনে দেখা যায় কোর্টের বিভিন্ন তলবকৃত বালাম ও সূচি সরকারি কর্মচারীর মাধ্যমে কোর্টে পাঠানোর নিয়ম থাকলেও রেকর্ড কিপার তাহার আস্থাভাজন নকল নবীশ বিপ্লব তালুকদারকে দিয়ে কোর্টে বালাম পাঠান।

অফিস সূত্রে আরো জানা যায়, বিগত কয়েক বছর পূর্বে শংকর নামক একজন নকল নবিশ এর মাধ্যমে বালাম বই পাঠালে, মামলার একটি পক্ষের সাথে আঁতাত করে উক্ত বালামের পাতা ছিঁড়ে ফেলা হয়, এবং তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার রেকর্ড কিপারকে দোষী সাব্যস্ত করে বরখাস্ত করেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রেকর্ডরুমে অঞ্জনা’র একটি সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় এ ধরনের অপকর্ম চালাচ্ছে। এই অপকর্মে তার অন্যতম সহযোগী নকল নবিশ জয়দেব পাল ও বিপ্লব সরকার। তাদের সহযোগী হিসেবে আছেন রেকর্ড রুমে এপ্রেনটিস হিসাবে কাজ করেন দশজনের বিশাল এক বাহিনী, শাহজাহান, মান্নান, বশির, জাহাঙ্গীর, সাগর,সবুর, জামাল, তৌফিক, বিপ্লব, সুধীর, ব্ল্যাক মন্নান, তাদের সরকারি ভাবে কোন বেতন না থাকলেও এই দশজনের বেতন বহন করেন রেকর্ড কিপার নিজেই।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায় রেকর্ডরুমে স্থায়ী সাব-রেজিস্ট্রার না থাকায়, খন্ডকালীন সাব-রেজিস্ট্রার দায়িত্বে থাকায় (যদিও বর্তমানে স্থায়ী সাব-রেজিস্ট্রার আছেন) রেকর্ড কিপার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে তার উল্লেখিত সহযোগীদের সহযোগিতায় এ ধরনের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।

এসব দুর্নীতির অভিযোগ আসার পরও অঞ্জনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামের উর্ধ্বতন এক অফিসারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় এবং মাসিক মাসোহারা’র বিনিময়ে রেকর্ড কিপার অঞ্জনা এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। এ সমস্ত অপকর্ম লুকানোর জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন অঞ্জনা।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে সাইফুল ইসলাম নামক এক ব্যক্তি একটি অভিযোগ রেজিস্টার্ড ডাকযোগে ঢাকায় মহাপরিদর্শক নিবন্ধন, আইন মন্ত্রণালয় এর আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একান্ত সচিব, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব একান্ত সচিব, এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান সহ আইন মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত সচিবালয়ের কয়েকজন সচিব বরাবর লিখিত ও অঞ্জনার অপকর্মের তথ্যসহ প্রেরণ করলেও অদ্যবধি তার বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

জানা গেছে রেকর্ড কিপারের এ সমস্ত দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় হতে অভিযুক্ত অঞ্জনা সেনের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ বর্তমানে পটিয়া সাব-রেজিস্ট্রারকে দায়িত্ব দিয়ে তদন্ত চলমান আছে।

বিশেষ সৃত্রে জানা যায়,অঞ্জনা ব্যক্তিগতজীবন সাদামাটা জীবন যাপন করলেও তার নামে একাধিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে, অঞ্জনা সেন উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অনৈতিক উপায়ে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর এই অপকর্মগুলো চালিয়ে গেছেন নির্বিঘ্নে।

কে এই বিপ্লব তালুকদার ও জয়দেব?

চট্টগ্রামের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের রেকর্ডরুমে অঞ্জনা সেনের বিশ্বস্ত সহযোগী ও সকল অপকর্মের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগী এই বিপ্লব তালুকদার এবং জয়দেব। অঞ্জনা সেনের বিশ্বস্ত সহকর্মী হিসেবে তারা জাল দলিল তৈরি করে মোট অংকের অর্থ আদায় করে জাল দলিল তৈরির গ্রাহকদের নিকট।

অভিযোগ রয়েছে অঞ্জনা সেনের প্রভাবে প্রভাবযুক্ত বিপ্লব এবং জয়দেবের দাপট রেকর্ড রুমসহ সদর সাব রেজিস্ট্রার অফিসে এতই ব্যাপক যে তাদের বিরুদ্ধে খোদ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ও ব্যবস্থা নিতে সমীহ করে । রেকর্ডরুমে ও সাব রেজিস্ট্রি অফিসে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন কর্মচারী বলেন, অঞ্জনা সেনের সকল অপকর্মের দোসর জয়দেব এবং বিপ্লব।

এদেরকে ব্যবহার করে অঞ্জনা সেন যেমন বিপুল বিত্ত – বৈভবের মালিক হয়েছেন ঠিক তেমনি এই দুজনকে ও আর্থিকভাবে সচ্ছল করে দিয়েছেন । সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে জাল দলিল তৈরির মাধ্যমে যে অপকর্ম তারা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে নিবন্ধন বিভাগের মহাপরিদর্শক (আই,জি,আর) শহিদুল আলম ঝিনুকের মোবাইলে কয়েকবার কল দিয়েও সংযুক্ত হওয়া সম্ভব হয়নি খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোন মন্তব্য করেন নাই।

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম জেলা সাব-রেজিস্ট্রার মনিরুজ্জামানকে মুঠোফোনে কল দেয়া হলে তিনি কল রিসিভ করেনি।

তবে বিষয়গুলো জানতে চট্টগ্রাম সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের রেকর্ড কিপার অঞ্জনা সেনের অফিসে গেলে তখন শাহজাজানসহ ও অন্যান্য দলিল লেখকরা প্রতিবেদকের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। তখন এ বিষয়ে নিউজ না করতে বার বার অনুরোধ করেন। পরে বিপ্লব তালুকদার প্রতিবেদককে মুঠোফোনে কল দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন।

প্রিয় পাঠক—দ্বিতীয় পর্বে থাকছে অঞ্জনা সেন ও তার সিন্ডিকেটের আরও ভয়াবহ দুর্নীতির তথ্য চিত্র।

সকালের-সময় ডটকম

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ