চট্টগ্রামেও রয়েছে ২৭৬ ট্রাক  

বিআরটিসির কেনা ৫০০ ট্রাক ৩ বছরে অকেজো!


নিজস্ব প্রতিবেদক ১৩ নভেম্বর, ২০২৩ ১:৫৬ : পূর্বাহ্ণ

বিপুল টাকা খরচ করে রাষ্ট্রীয় সড়ক পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসির) প্রায়ই নতুন বাস-ট্রাক কিনলেও স্বল্পসময়ে তা নষ্ট হয়ে যায়। যে লাইফ টাইমের কথা বলে এসব গাড়ি আনা হয় তার তিন ভাগের এক ভাগ সময়ও সেগুলো রাস্তায় চলার নজির নেই। বরং বছর দুই-তিন ঘুরতে না ঘুরতেই ঠাঁই হয় মেরামত কারখানায়। এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে বিআরটিসির পরিবহনগুলো এত স্বল্পসময়ে কীভাবে নষ্ট হচ্ছে।

সাশ্রয়ী ভাড়ায় দেশব্যাপী পণ্য পরিবহনসেবা দিতে বছর তিনেক আগে দুই প্যাকেজে মোট ৫০০টি ট্রাক কেনে বিআরটিসি। এতে সব মিলিয়ে খরচ হয় ১১৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ভারতের আইশার মোটরস লিমিটেডের কাছ থেকে কেনা ট্রাকগুলো এরই মধ্যে নষ্ট হওয়ার পথে। মরিচা পড়ে ছিদ্র হয়ে গেছে এর বডি।

অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের কারণে অনেকগুলোর বডি ভেঙে গেছে। দুর্বল ইঞ্জিন কয়েকদিন পরপর মেরামতে খরচ বাড়ছে বিআরটিসির। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।

জানা গেছে, দুই প্যাকেজে ২০১৯ সালে ভারত থেকে ৫০০ ট্রাক কেনে বিআরটিসি। এর মধ্যে একটি প্যাকেজে কেনা হয় ৩৫০ ট্রাক, যেগুলোর প্রতিটিরই পণ্য পরিবহনের ধারণক্ষমতা ১৫ টন। এর জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) ১২৫ কোটি টাকা সংস্থান ছিল। সে হিসাবে প্রতিটি ট্রাকের পেছনে গড়ে ৩৫ লাখ ৭১ হাজার টাকা (খুচরা যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক সেবা এবং আমদানি শুল্ক ও ভ্যাটসহ) জোগান দেয় সরকার। যদিও সেগুলো কিনতে বিআরটিসি খরচ করেছে ৭৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে প্রতিটি ট্রাকের পেছনে গড়ে ২১ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ব্যয় হয়।

দ্বিতীয় প্যাকেজে কেনা হয় ১০ টন ধারণক্ষমতার ১৫০ ট্রাক। প্রতিটির জন্য গড়ে ৩১ লাখ টাকা ধরে ডিপিপিতে সংস্থান ছিল ৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ট্রাকগুলো কিনতে যদিও ২৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা খরচ করেছে বিআরটিসি। সে হিসাবে প্রতিটির দাম পড়েছে ১৫ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।

অর্থাৎ ডিপিপিতে যে পরিমাণ অর্থের সংস্থান ছিল, দুটি প্যাকেজেই তার চেয়ে অর্ধেক দামে ট্রাকগুলো কেনা হয়েছে। নতুন কেনা ৫০০ ট্রাকের ২০৬টি বর্তমানে আছে বিআরটিসির ঢাকা ডিপোয়, চট্টগ্রাম ডিপোয় রাখা হয়েছে ২৭৬টি। বাকিগুলো রয়েছে বিআরটিসির ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে।

বিআরটিসির জন্য ট্রাক সংগ্রহ’ প্রকল্পটির ওপর সম্প্রতি একটি সমাপ্ত প্রকল্প মূল্যায়ন (পিসিআর) প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইএমইডি। গাড়িগুলো পর্যবেক্ষণ করে সংস্থাটি বলছে, এগুলোর ইঞ্জিন ও বডি অনেক দুর্বল। বেশির ভাগেরই বাহ্যিক অংশ এরই মধ্যে ছিদ্র হয়ে গেছে। বৃষ্টিতে মালপত্র পরিবহন করলে ভিজে যায়। সব মিলিয়ে বিআরটিসির কেনা ৫০০ ট্রাককে নিম্নমানের বলে আইএমইডি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

আইএমইডি বলছে, সংস্থানের চেয়ে প্রায় ৯৮ কোটি টাকা কম দামে কেনা হলেও ট্রাকগুলো নিম্নমানের বলে প্রতীয়মান হয়। অথচ সমুদয় অর্থ দিয়ে উন্নত মানের ট্রাক কেনা যেত। তাতে এসব গাড়ির স্থায়িত্ব বেশি হতো এবং সরকারের রাজস্ব আয়ে দীর্ঘ সময় অবদান রাখত। কম টাকায় নিম্নমানের ট্রাক কেনার বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়ারও সুপারিশ করেছে আইএমইডি।

বিআরটিসির তেজগাঁও ডিপোয় ট্রাকগুলো পর্যবেক্ষণ করেন আইএমইডির সহকারী পরিচালক মো. কামাল হোসেন। মূল্যায়ন প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন, ক্রয়কৃত আইশার মোটরসের ট্রাকগুলোর বডিসহ ওপরের বিভিন্ন অংশে ফাটল, ছিদ্র ও মরিচা পড়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় সেগুলো যথাযথ মানসম্পন্ন নয়।

গাড়িগুলোর বডি ভলভো ট্রাকের চেয়ে অনেক দুর্বল হওয়ায় অনেক জায়গায় ভেঙে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে পরিবহনের সময় মালপত্র ভিজে যায়। এ কারণে প্রায়ই জরিমানা দিতে হয় এবং ট্রাকগুলো মেরামত করতে হচ্ছে। আবার কখনো কখনো ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত মালপত্র নেয়ায় বডি ভেঙে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ পর্যবেক্ষণে আইশার কোম্পানির ১৫ ও ১০ টনের ট্রাকগুলোকে নিম্নমানের বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

অর্থ সংস্থানের পরও নিম্নমানের ট্রাক কেনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মন্তব্য জানতে চাইলে বিআরটিসির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, ট্রাকের মান সম্পর্কে বলতে হলে আমাকে জেনে বলতে হবে। কারণ এ ট্রাকগুলো কেনার সময় আমি বিআরটিসির দায়িত্বে ছিলাম না।

আইএমইডি যদি এ ধরনের কোনো পর্যবেক্ষণ দেয় সেটা আমরা খতিয়ে দেখব। তবে তিনি দাবি করেন, ‘‌এখন আমাদের গাড়ির অবস্থা ভালো। সংস্থার রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাটি আগে খুব একটা ভালো ছিল না। বর্তমানে আমরা গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণকে যে মানে উন্নীত করেছি, আগামী ১০ বছরেও এসব ট্রাকের কোনো সমস্যা হবে না।

সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন ও পুরনো মিলিয়ে বিআরটিসির বহরে বর্তমানে ট্রাক রয়েছে ৫৯০টি। পণ্য পরিবহন করে ২০২২-২৩ অর্থবছর সংস্থাটি ১৭১ কোটি টাকা আয় করেছে।

তারা জানান, সচল ট্রাক দিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সার, কৃষি উপকরণ, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, কাগজসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সাশ্রয়ী মূল্যে নিরাপদে পরিবহনসেবা দেয়া হচ্ছে। এর বাইরে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ দেশের বিভিন্ন দুর্যোগ ও আপৎকালীন এসব ট্রাক দিয়ে সাশ্রয়ী ভাড়ায় পণ্য পরিবহনে অনন্য ভূমিকা রাখছে বিআরটিসি।

সূত্র—বিবি

সকালের-সময়/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ