বান্দরবানে এলজিইডির সড়ক নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতি!


নিজস্ব প্রতিবেদক ১১ ডিসেম্বর, ২০২২ ৩:১৩ : অপরাহ্ণ

কোনো ধরনের তদারকি ছাড়াই বান্দরবানের টংকাবতীতে চলছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সড়কের নির্মাণকাজ। সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে তিনটি প্যাকেজে প্রায় ১১ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণকাজে নিম্মমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে।

যেনতেন ভাবে ২০ শতাংশ কাজ না করেই কৌশলে গত বছর প্রথম দফায় আগাম ৫০ শতাংশ কাজের বিল উত্তোলন করে নিয়েছে প্রভাবশালী ঠিকাদাররা। রাস্তায় বালি দেয়ার নামে প্রকৃতি ধ্বংস করে এক্সাভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে সড়কে ব্যবহার করা হচ্ছে পাহাড়ের লালমাটি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বান্দরবান সদর উপজেলার টংকাবতী হাতিরডেরা সড়কে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও নয়ছয় কাজ করছেন সড়কের দ্বিতীয় ও তৃতীয় নম্বর প্যাকেজে। এক নম্বর ইট ব্যবহারের কথা থাকলেও ড্রেনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে দুই-তিন নম্বর মানের ইট। সাববেইজ তৈরি না করেই মাটি কেটে করা কাঁচা সড়কের ওপর তড়িঘড়ি করে ডাম্পার ট্রাকে করে ঢেলে দেয়া হচ্ছে বালিমিশ্রিত কংক্রিটের বড় খোয়া (মেকাডম)।

সঙ্গে সঙ্গেই শ্রমিকরা সড়কের লেভেল মেলাচ্ছেন আর তাৎক্ষণিকভাবে রোলার দিয়ে ডলে সমান করা হচ্ছে ভালোমন্দ-মিশ্রিত খোয়ার মেকাডম। রোলার দিয়ে ডলা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে খোয়াগুলো। তবে অনিয়ম ঢাকতে ঠিকাদাররা তড়িঘড়ি করে নির্মাণকাজ চালালেও তিনটি প্যাকেজের কোথাও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তাকেই দেখা যায়নি।

কার্যাদেশের শর্ত মোতাবেক সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিজ নিজ কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশল তদারকি করার কথা থাকলেও তাদেরও খুঁজে পাওয়া যায়নি। রাস্তায় বালি দেয়ার নামে এক্সাভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে সাবাড় করে পাহাড়ের লাল মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। পাহাড় কেটে হাতিরডেরা এলাকায় প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করছে ঠিকাদাররা।

নির্মাণকাজের শ্রমিকরা জানান, খারাপ ইট ও খোয়ার মেকাডমমিশ্রিত থাকায় সবাই অভিযোগ করছে। প্রতিদিনই নানা মানুষের কটু কথা শুনতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের বিষয়টি জানিয়েছি আমরা। কিন্তু ঠিকাদার কাজ চালিয়ে যেতে বলছেন, আমরা শ্রমিকরা কী করব? সবাই তো আমাদেরই গালাগাল করে।

এক রাজমিস্ত্রি বলেন, ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। আমরা ঠিকাদারের কাজ করি, ঠিকাদার যেমন মালামাল দিচ্ছেন, যেভাবে কাজ করতে বলছেন, আমরা ঠিক তেমনিভাবেই কাজ করছি। দায়দায়িত্ব ঠিকাদারের এবং অফিসের।

এলজিইডি অফিস ও স্থানীয়দের তথ্যমতে, বান্দরবান সদর উপজেলার টংকাবতী ইউনিয়নের লামা-সূয়ালক রাস্তা থেকে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চরম্বা সড়ক পর্যন্ত হাতিরডেরা প্রায় এগারো কিলোমিটার সড়ক নির্মাণকাজের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছিল ২০২১ সালে। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে সড়ক নির্মাণকাজের সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর বর্ধিত সময় নিয়ে নির্মাণকাজ শুরু করেছে ঠিকাদার। কিন্তু দ্বিতীয় প্যাকেজের কাজ ৫০ ভাগও এগুতে পারেনি।

তবে—প্রথম ও দ্বিতীয় প্যাকেজের কাজ ৬০-৭০ শতাংশের মতো শেষ হয়েছে। সড়কের শূন্য থেকে তিন হাজার ৯২০ মিটার পর্যন্ত প্রথম প্যাকেজের কাজটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইমু কনস্ট্রাকশনের নামে বাস্তবায়ন করছেন ঠিকাদার মো. মোজাফফর। কাজের প্রাক্কলিত মূল্য পাঁচ কোটি ৯৮ লাখ টাকা হলেও অফিস মেনেজ করে ব্যয় বাড়িয়ে ছয় কোটি ৩৯ টাকায় চুক্তিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এরই মধ্যে বিল তুলে নিয়েছেন দুই কোটি ৩৫ লাখ টাকা। পরের প্যাকেজটি ৯২১ মিটার থেকে ছয় হাজার ৭৩০ মিটার পর্যন্ত সড়ক নির্মাণকাজটি পেয়েছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএম ট্রেডার্স। কিন্তু কাজটি বাস্তবায়ন করছেন আওয়ামী লীগ নেতা উজ্জ্বল কান্তি দাস ও তাপস দাস। এ কাজে প্রাক্কলিত মূল্য চার কোটি ৫৫ লাখ টাকা থেকে ব্যয় বাড়িয়ে চার কোটি ৮৬ লাখ টাকায় চুক্তিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কাজের কোনো অগ্রগতি না থাকলেও এরই মধ্যে বিল উত্তোলন করে নিয়েছেন এক কোটি নয় লাখ টাকা। দীর্ঘদিন পর গত মাসে আবার কাজ শুরু করেছেন ঠিকাদার।

শেষের প্যাকেজটি দ্বিতীয় প্যাকেজের শেষাংশ থেকে ১০ হাজার ৯৮০ মিটার পর্যন্ত কাজ পেয়েছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইউটিমং। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন করছেন ঠিকাদার জসিম উদ্দিন ও সায়েদুল ইসলাম জুয়েল সিন্ডিকেট। এ কাজেও প্রাক্কলিত মূল্য ছয় কোটি ৩৯ লাখ টাকা থাকলেও ব্যয় বাড়িয়ে ছয় কোটি ৮৯ লাখ টাকায় চুক্তিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এলজিইডির কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করে গতবছরই বিশ শতাংশ কাজ শেষ না করেই তিন কোটি সাত লাখ টাকা ৫০ শতাংশ কাজের বিল উত্তোলন করে নিয়েছিল ঠিকাদার। তবে দীর্ঘদিন পর নতুন করে কাজ শুরু করেছে ঠিকাদার। এরই মধ্যে কাজের অগ্রগতিও এগিয়েছে ৫০ শতাংশের মতো।

স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, সড়ক নির্মাণকাজে কোনো তদারকি নেই। ঠিকাদার নিজের ইচ্ছামতো অনিয়ম করছেন সড়ক নির্মাণকাজে। নিম্মমানের কংক্রিট, বালি, ইট, লোহা ব্যবহার করে সড়ক, ড্রেন ও গাইড ওয়ালের কাজ করছেন। সাববেইজ তৈরি না করেই মাটি কেটে কাঁচা সড়কের ওপরে ডাম্পার ট্রাকে করে ঢেলে দেয়া হচ্ছে ভালোমন্দ মিশ্রিত খোয়ার মেকাডম। সঙ্গে সঙ্গেই রোলার দিয়ে ডলা দিয়ে সমান করায় অনিয়মগুলো চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে।

নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক কয়েকজন ঠিকাদার সকালের-সময়কে বলেন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়াউল ইসলাম মজুমদার, সদর উপজেলা প্রকৌশলী বিএম মাহমুদুল হাসান ও সড়ক নির্মাণকাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলজিইডি সহকারী প্রকৌশলী আমানুর রহমানসহ এই অফিসের টেবিলে টেবিলে কাজের ১০% পর্যন্ত টাকা দিয়ে দিতে হয়েছে, তাই আমাদের ও অনিয়ম দুর্নীতি করতে হচ্ছে। তারা টাকা না নিলে আমরাও হয়তো অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি ভেবে দেখতাম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এলজিইডি বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়াউল ইসলাম মজুমদার সকালের-সময়কে বলেন–আমি টিম পাঠিয়েছি, উপজেলা প্রকৌশলীকে পাঠিয়েছি, তারা বলেছে এখানে ইটের মান মোটামুটি ঠিক আছে, আমরা বান্দরবানে সবচেয়ে কোয়ালিটিফুল কাজ করার চেষ্টা করি, লেবারের অবহেলার কারণে যদি কোন ওয়ার্কম্যানশিপে সামান্য ভুলক্রুটি থেকে থাকে সেটা ভিন্ন কথা। কাজ করতে গেলে ভুল হবে, অনিয়ম হবে। যে কাজ করে তার ভুল হবে।

সূত্র—এসবি/এসএস/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ