মঞ্জুরি কমিশনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি 

নির্দেশনা উপেক্ষা করে ১৫ শিক্ষক নিয়োগ দিল চবি!


নিউজ ডেস্ক  ২১ ডিসেম্বর, ২০২২ ২:০৫ : পূর্বাহ্ণ

নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছর ফোনালাপের দুটি ঘটনা ফাঁস হয়েছে। এ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হওয়ায় এক পর্যায়ে নতুন নিয়োগে বিধিনিষেধ আরোপ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। নিয়োগ কেলেঙ্কারির বিষয় নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে শিক্ষক কিংবা অন্য কোনো পদে লোক নিয়োগে অনুমোদন দেওয়া হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছিল মঞ্জুরি কমিশন।

কিন্তু এ নির্দেশনা উপেক্ষা করে ১৫ শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া আরেকটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়েছে বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ‘অযোগ্য’ ২৪ প্রার্থীকে। এ নিয়ে আদালতে মামলা হওয়ায় আটকে গেছে সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া। নিয়োগ নিয়ে এতসব অনিয়মের কারণে নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়েছে চবি কর্তৃপক্ষ।

গত ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগের বিষয়ে উপাচার্যের সহকারীর ফোনালাপ ফাঁসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নিয়োগের অনুমোদন আটকে দিয়েছিল ইউজিসি। গত মার্চে নিয়োগে অর্থ লেনদেনের ঘটনায় অভিযুক্ত হন উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী খালেদ মিছবাহুল ও হিসাব নিয়ামক অধিদপ্তরের কর্মচারী আহমদ হোসেন।

এর পাঁচ মাস পরই গ্রন্থাগার সহকারী মানিক চন্দ্র নিয়োগের কথা বলে তিন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা নিয়েছেন- এমন অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। প্রথম ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদনের পাঁচ সুপারিশ ৮ জুলাই সিন্ডিকেট সভায় গ্রহণ করা হয়।

উপাচার্যের সহকারীকে পদাবনতি ও হিসাব নিয়ামক অধিদপ্তরের কর্মচারীকে বরখাস্ত এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার লক্ষ্যে উপাচার্য দপ্তরের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী, শিক্ষক নিয়োগ শাখার সেকশন অফিসার সাকির মিয়াকে প্রশাসনিক ভবনের বাইরে বদলি করার জন্য বলা হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত চক্রকে খুঁজে বের করতে ফৌজদারি আইনে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয় সিন্ডিকেট।

কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়নি। উপাচার্যের সহকারী খালেদ মিছবাহুলকে এই দায়িত্ব থেকে সরানো হলেও উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে তিনি বহাল আছেন। নিয়ামক অধিদপ্তরের কর্মচারী আহমদ হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনার চার মাস পেরিয়ে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়নি সিন্ডিকেটে।

নির্দেশনা ও নিয়ম অমান্য করে এভাবে লোকবল নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য ও চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, নিয়োগ-সংক্রান্ত আগের দুই ঘটনার প্রতিবেদন আমরা পাইনি।

এখন বিজ্ঞপ্তির বাইরে অতিরিক্ত ১৫ জন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়োগের বিষয়েও ইউজিসিকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। যদি অনুমোদন ও নিয়োগবিধি অমান্য করে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান বলেন, ‘দ্বিতীয় ঘটনাটির প্রতিবেদন আমরা পেয়েছি। পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় এ বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে। আমরা দুটি ঘটনা নিয়ে একসঙ্গে কাজ করব।

নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ

নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই গত ১৪ অক্টোবর ২১ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ‘নিয়ম ভেঙে’ বিজ্ঞপ্তির পদের বাইরে ১৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা ২৩ অক্টোবর থেকে যোগদানও করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে উপাচার্যের সহকারীর ফোনালাপ ফাঁসের পর আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

ইউজিসি ৫ জুন এক চিঠিতে জানায়, এ ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে জনবল নিয়োগের বিষয়ে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। কিন্তু এর তোয়াক্কা না করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে চবি শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ও আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, সাধারণত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসির অনুমোদন প্রয়োজন। বিজ্ঞপ্তির পদের বাইরে নিয়োগ দেওয়া আইনের লঙ্ঘন।

গত ৭ জুলাই চবির ৫৩৮তম সিন্ডিকেট সভায় বিজ্ঞপ্তির বাইরে অতিরিক্ত নিয়োগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই দিন অতিরিক্ত নিয়োগের সুপারিশ না থাকায় ১১ জনকে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। এর তিন মাস পর সিন্ডিকেট ৫৩৯তম সভায় এ সিদ্ধান্ত সংশোধন করে অতিরিক্ত ওই ১১ জন ও নতুন চারজনকে নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে।

অতিরিক্ত পদে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে সমাজতত্ত্ব বিভাগ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ ও ফার্মেসি বিভাগে তিনজন করে, জিন প্রকৌশল ও জীব প্রযুক্তি বিভাগে চারজন, ইংরেজি ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগে একজন করে নিয়োগ পেয়েছেন। অতিরিক্ত পদে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে জানতে উপাচার্য শিরীণ আখতারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি পুরোনো বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না।

নতুন কোনো বিষয় থাকলে আলোচনা করতাম। সিন্ডিকেট সদস্য ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর বলেন, ‘সিন্ডিকেট সরাসরি নিয়োগ দেয় না। নিয়োগের সুপারিশ করে সিলেকশন বোর্ড। এতে বিভাগের সভাপতি, উপাচার্য ও সংশ্নিষ্ট বিভাগে অভিজ্ঞ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা থাকেন। সিন্ডিকেট শুধু ওই বোর্ডের সিদ্ধান্ত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে অনুমোদন দেয়।

আদালতের স্থগিতাদেশ

নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলার মধ্যেই আরেকটি নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ পেল চবি। সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগে বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী অযোগ্য প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকায় নিয়োগ বোর্ড স্থগিত করতে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ১১ ডিসেম্বর ওই বিভাগের দুই শিক্ষকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেওয়া হয়।

ছয়জন প্রভাষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়া দুই শিক্ষক হলেন- মোহাম্মদ অহিদুল আলম ও এনামুল হক। ওই দুই শিক্ষকের পক্ষের আইনজীবী পলাশ চন্দ্র রায় বলেন, ওশানোগ্রাফি বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির সদস্যদের সুপারিশ না নিয়েই প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের জন্য ডেকেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এর পরিপ্রেক্ষিতেই গত ৫ ডিসেম্বর কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণার জন্য মামলা করেছিলেন। এ সিদ্ধান্তের ওপর হাইকোর্ট রুল জারি করে ছয় মাসের জন্য নিয়োগ বোর্ড স্থগিত করেছেন। সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও প্ল্যানিং কমিটির সদস্য ড. মোহাম্মদ অহিদুল আলম বলেন, বিজ্ঞপ্তির শর্ত পূরণ করেছেন মাত্র তিনজন প্রার্থী।

তাই আমরা আবার বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার সুপারিশ করি। কিন্তু প্ল্যানিং কমিটিকে কিছু না জানিয়েই ২৪ জনকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়েছে। নিয়ম না মেনে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলতে থাকায় আমরা মামলা করেছি।

সূত্র—এসকে/এসএস/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ