দুর্নীতির বরপুত্র সালামের হাতে জিম্মি স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল!


নিজস্ব প্রতিবেদক ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১:১৯ : পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) সহকারী ব্যবস্থাপক (বিক্রয়) আবদুস সালাম মীর। প্রতিষ্ঠানটি থেকে তিনি মাসে সাকুল্যে বেতন পান ৮৬ হাজার ৫২৫ টাকা। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের প্রতি মাসে কিস্তি শোধ করেন ১ লাখ ৪৯৯ টাকা। বেতনের চেয়ে ঋণের কিস্তির পরিমাণ বেশি-তিনি পারিবারিক খরচ কীভাবে সামলান, এমন প্রশ্ন উঠেছে। এমন প্রশ্ন এখন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে মুখে।

আবদুস সালাম মীর এসএওসিএলের কর্মকর্তাদের সংগঠন স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সরবরাহের দায়িত্বে। অভিযোগ উঠেছে, সরকারি এলপি গ্যাসের দাম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মূল্যের অর্ধেকের চেয়েও কম হওয়ার সুযোগে সিন্ডিকেট কারসাজিতে মাসে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।

চিহ্নিত ডিলারদের সঙ্গে সিন্ডিকেট কারসাজির মাধ্যমে তিনি নামে বেনামে অগাধ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ। বর্তমানে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে ১২ কেজির এলপি গ্যাসের নির্ধারিত দাম ১২৮৪ টাকা। সেখানে বিপিসির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডের (এলপিজিএল) সাড়ে ১২ কেজি গ্যাসের দাম মাত্র ৫৯১ টাকা।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বিপিসির মালিকানাধীন অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এলপিজিএল’র চট্টগ্রাম প্ল্যান্টে বছরে ১০-১২ হাজার টন এলপি গ্যাস বোতলজাত করা হয়। বোতলজাত গ্যাস বিপিসি বিপণনকারী তিন অঙ্গ প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েল এবং এসএওসিএলের মাধ্যমে বিপণন করে। বেসরকারি এলপি গ্যাসের চেয়ে সরকারি এলপিজিএলের বোতলজাত গ্যাসের দাম অর্ধেকের চেয়েও কম। এ সুযোগে ডিলারদের একটি সিন্ডিকেট উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্য বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো এসএওসিএল নিয়মিতভাবে এলপিজিএল থেকে বোতলজাত এলপি গ্যাস নিয়ে ডিলারদের মধ্যে বিপণন করে। তবে এসএওসিএলের সুবিধা হচ্ছে, প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি এলপি গ্যাস চট্টগ্রামের ডিলারদের মধ্যে বিপণন করতে হয়। বিপিসির তথ্য অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির এলপিজি ডিলার ৩৭১ জন। তার মধ্যে ৩০৩ জনই চট্টগ্রামের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিপিসির এলপি গ্যাসের কেনা মূল্য কম। লাভ করেও বাজারে সাড়ে ১২ কেজির গ্যাস ৫৯১ টাকায় বিক্রির কথা থাকলেও অনেক বেশি দামে বাজারে বিক্রি করা হয়। অন্যদিকে ডিলারদের আনুপাতিকহারে এলপিজি বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও রয়েছে কারসাজি। ছোট ডিলারদের নামে বরাদ্দ দেখিয়ে মূলত ৭-৮ জন ডিলার বোতলজাত এলপি গ্যাস এলপিজিএল থেকে ছাড়িয়ে নেন। এসএওসিএলে এলপিজি সরবরাহে সিন্ডিকেট ডিলারদের নিয়ন্ত্রণ করেন আবদুস সালাম মীর। তিনি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এসএওসিএলের এলপিজি বিপণনের দায়িত্বে।

এলপিজিএলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৭৪৯ টন, যা সাড়ে ১২ কেজি হিসেবে এক লাখ ৩৯ হাজার ৯২০ সিলিন্ডার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১১১ টনে ৮৮ হাজার ৮৮০ সিলিন্ডার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৬২৪ টনে ২ লাখ ৯ হাজার ৯২০ সিলিন্ডার এলপি গ্যাস বিক্রি করেছে এসএওসিএল।

এদিকে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি দুদক হটলাইনে আসা এক অভিযোগের সূত্র ধরে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখায় অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমেদ ও তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ শাহেদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা স্থানান্তরের প্রমাণ পায় দুদক।

২০২০ সালের ১৮ আগস্ট করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান মো. শাহেদ। তবে তার মৃত্যুর আগেই জিএম হিসেবে দায়িত্ব পালনের শেষ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কোনো ধরনের নিয়মনীতি ব্যতিরেকে বড় অঙ্কের গৃহ নির্মাণ ঋণ নেন। তার মধ্যে আবদুস সালাম মীর নেন ৩৬ লাখ টাকা। যদিও তিনি বেতনের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৮ লাখ টাকা ঋণ পাওয়ার যোগ্য।

গণ মাধ্যমের হাতে আসা এসএওসিএলের ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের কর্মকর্তাদের পে-রোল শিট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সহকারী ব্যবস্থাপক (বিক্রয়) আবদুস সালাম মীরের মূল বেতন ৫৭ হাজার ৮৭০ টাকা। তিনি প্রভিডেন্ট ফান্ড, হাউজ বিল্ডিং ঋণ, বেতনের বিপরীতে অগ্রিম কর বাদ দিয়ে সাকুল্যে ৮৬ হাজার ৫২৫ টাকা বেতন পান, যা তার ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। কিন্তু ঋণের টাকা ফেরতের ক্ষেত্রে এসএওসিএলের পক্ষ থেকে আবদুস সালাম মীরকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়।

পে-রোল শিটের শেষাংশে উল্লেখ করা হয়েছে, আবদুস সালাম মীর সহকারী ব্যবস্থাপক (বিক্রয়) মহোদয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার গ্রহণ করা গৃহনির্মাণ ঋণের অতিরিক্ত টাকার কিস্তি বাবদ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে প্রতি মাসের বেতন প্রদানের আগে চেকের মাধ্যমে কিস্তি বাবদ ১,০০,৪৯৯ টাকা করে গ্রহণ করা হবে।

বেতনের চেয়েও প্রায় ১৪ হাজার টাকা বেশি কিস্তি শোধ করায় আবদুস সালাম মীরের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবদুস সালাম মীর হালিশহর চুনা ফ্যাক্টরি মোড় এলাকার খালেক টাওয়ারের ৭ম তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। ওই ফ্ল্যাটের ভাড়া সার্ভিস চার্জসহ ২৫ হাজার টাকা। তাছাড়া তার দুই সন্তানও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে।

এ ব্যাপারে আবদুস সালাম মীরের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে এসএওসিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মণি লাল বলেন, প্রথমে কয়েকজনকে গৃহনির্মাণ ঋণ দিয়েছিল। যাদের চাকরি পাঁচ বছর হয়েছে তাদের এ ঋণ দেওয়া হতো। পরে যখন দেখা গেলো অনেকের ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেশি, ২৫-৩০ লাখ টাকা ঋণ।

তখন ৪০২তম বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ঋণসীমার অতিরিক্ত নেওয়া ঋণ প্রতিষ্ঠানকে ফেরত দিতে হবে। এরপর কিস্তি করে তাদের কাছ থেকে ঋণ ফেরত নেওয়া হচ্ছে। ওই তালিকায় আবদুস সালাম মীরও রয়েছেন। আবদুস সালাম মীর ঋণ নিয়েছিলেন ৩৬ লাখ টাকা। কিন্তু তার ঋণসীমা ছিল সর্বোচ্চ ৮ লাখ। এখন মাসিক কিস্তিতে এসব ঋণ পরিশোধ করছেন। সালাম মীর অতিরিক্ত ২৮ লাখ টাকার মধ্যে ২০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন।

এলপিজি বিপণনে আবদুস সালাম মীরের অনিয়মের বিষয়ে মণি লাল বলেন, বিষয়টি তদন্তের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে অনিয়ম পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমার পর্যায় থেকে সম্ভব না হলে বিষয়টি বোর্ডে তোলা হবে। অনিয়মের বিষয়ে কোনো ছাড় নয়।

সূত্র—জেএন/সকালের-সময়/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ