দুর্নীতির আতুড়ঘর চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়!


মোহাম্মদ ফোরকান  ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২ ৩:০১ : পূর্বাহ্ণ

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। রীতিমত ঘুষের হাট খুলে বসেছে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের কার্যালয়! ওপেন সিক্রেট এই ঘুষ আদায়ের জন্য বসানো হয়েছে দুর্নীতিপরায়ণ কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। সিভিল সার্জনের এই আস্থাভাজনরা সেবা গ্রহীতাদের জিম্মি করে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে আদায় করছেন রমরমা ঘুষের টাকা। বিশেষ করে সরকারি চাকুরীজীবি, বিদেশ প্রার্থী, করোনা ভ্যাকসিন বুথ বসিয়ে ভিআইপি কালেকশন ও বিভিন্ন ল্যাব, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল ভিজিটের নামে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব মালিকরা নতুন লাইসেন্স ও পুরনো লাইসেন্স নবায়নে অনলাইন আবেদনের পর পরিদর্শনের জন্য ভিড় জমান সিভিল সার্জন কার্যালয়ে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী সিভিল সার্জন হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন দিয়ে থাকেন। মূলত এই প্রতিবেদনের ওপরই নির্ভর করে থাকে লাইসেন্সের ভাগ্য।

কিন্তু–অভিযোগ রয়েছে প্রতিটি অনলাইন আবেদন পরীক্ষার জন্য ৫-১০ হাজার টাকা এবং প্রতিটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব পরিদর্শনের পর পজিটিভ রিপোর্টের জন্য ২০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেয়া হচ্ছে। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের বিভাগীয় স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া, হেল্থ এডুকেটর প্রবীর মিত্র, হেল্থ এডুকেটর সম্পদ দে, স্যানেটারী ইন্সপেক্টর টিটু পাল, হেল্থ ইন্সপেক্টর কাজি মাসুদ ও হিসাব রক্ষক মিলে আদায় করছেন এই ঘুষের টাকা।

সূত্র জানায়, প্রতিটি লাইসেন্স নবায়নের জন্য সিভিল সার্জনের নামে ২০-৫০ হাজার টাকা করে এবং নতুন লাইসেন্সের জন্য ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ গুনতে হয়েছে। এই হিসেবে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাবের কাছ থেকে সিভিল সার্জনের সিন্ডিকেট আদায় করছে প্রায় কোটি কোটি টাকা।

সূত্র আরও জানায়, লাইসেন্সের জন্য বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাবের অনলাইন আবেদন, পরিদর্শন এবং মেডিক্যাল ফিটনেস থেকেই বেশির ভাগ ঘুষ আদায় করছেন এই সিন্ডিকেট। এর বাইরে বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শনের সময় ‘খাম গিফট’ নিয়ে সিভিল সার্জন অফিসের কর্মকর্তারা পকেট ভারি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে স্থানীয় বেসরকারী হাসপাতালের মালিকসহ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জিম্মি হয়ে পড়েছে।

এক ভুক্তভোগী জানান, কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন-এসিআরসহ হয়রানির ভয়ে এসব নিয়ে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছে না কেউ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে সিভিল সার্জন ও তার সাঙ্গুপাঙ্গুরা আমাদের দাপট দেখান। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সিন্ডিকেটের ঘুষ দুর্নীতি নিয়ে (দুর্নীতি দমন কমিশন) দুদকের তদন্ত দাবি করেছেন এই ভুক্তভোগী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, গত এক বছর আগে বদলি হয়ে আসা এই সিভিল সার্জন টাকা ছাড়া কিছুই বোঝেন না! বিভিন্ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো পরিদর্শনের সময় কেবল ‘খাম ভর্তি’ টাকার জন্য পদস্থ কর্মকর্তাদের প্রকাশ্য গালমন্দসহ অপমান অপদস্থ করে থাকেন তিনি। বেশিরভাগ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এরকম পরিস্থিতির শিকার হলেও এসিআর এর ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না কেউ।

আর এদিকে পেশাজীবী সংগঠনগুলোর স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় তারাও প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছেন না। বেসরকারী হাসপাতাল মালিকরা অভিযোগ করে জানায়, লাইসেন্স নবায়নের জন্য সিভিল সার্জনের পরিদর্শনের সময় তাদের লাখ লাখ টাকা গুনতে হয়। হয়রানির ভয়ে বেশিরভাগ হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব মালিক মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, নামকাওয়াস্তে কোন কোন হাসপাতাল ও ল্যাব পরিদর্শনে গেলেও বেশিরভাগ পরিদর্শন ছাড়াই কেবল টাকার বিনিময়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরে। পরিদর্শন টিমের একাধিক সদস্য অবশ্য স্বীকার করে সিভিল সার্জন কার্যালয় প্রস্তুত করার পর তাদের স্বাক্ষর নেয়া হয়।

প্রচার রয়েছে, পরিদর্শন টিমের সদস্যরা পরিদর্শন ছাড়াই প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করে ভাগ পান ঘুষের টাকা। সবচেয়ে বেশি ঘুষ আদায় ফিটনেস সনদে। সবচেয়ে বেশি ঘুষ আদায়ের ঘটনা নতুন চাকুরেদের ফিটনেস ও অবসরে যেতে ইচ্ছুক সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সনদে!

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সরকারী-বেসরকারী সংস্থায় নিয়োগলাভের পর মেডিক্যাল ফিটনেস সনদের জন্য প্রার্থীরা ভিড় জমান সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে। বছরে গড়ে ৩ হাজার থেকে ৫ প্রার্থী এই সনদ নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। প্রচার রয়েছে, সিভিল সার্জন ও তার সিন্ডিকেট মেডিক্যাল ফিটনেস সনদের বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা।

এসবের বাইরে সরকারী চাকরিজীবীদের কেউ অসুস্থতার জন্য মেয়াদের আগে অবসরে যেতে চাইলে মেডিক্যাল বোর্ডের সনদ প্রয়োজন হয়। সেখানেও এই চক্র হাতিয়ে কয়েক লক্ষ টাকা।

সিভিল সার্জন নগরীর বিভিন্ন হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক পরিদর্শকালে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখার পর যে সকল প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন হয়নি এবং পরিদর্শনকালে বিভিন্ন অনিয়ম পাওয়া গেছে, তাদের সংশোধনপূর্বক ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সিভিল সার্জনের কাছে জবাব দিতে বলা হয়। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় লাখ লাখ টাকা। গুঞ্জন রয়েছে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা সিভিল সার্জনের সঙ্গে দেখা করে সবকিছু রফা করেছেন।

অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে জানার জন্য সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীর মুঠোফোনে কল দেয়া হলে তিনি সকালের-সময়কে বলেন, আপনার কিছু জানার থাকলে অফিসে আসুন, ফোনে এতকিছু বলা যায় না, আর কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে আমাকে দিন, আমি ব্যবস্থা নিব।

উল্লেখ্য—গত শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ে রাত নয়টায় দরজা জানালা বন্ধকরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্বাচিত সহকারী শিক্ষকদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় ধরা পড়ে এই সংঘবব্ধ চক্রটি। তখন এই কাজের মুল নায়কের ভুমিকায় ছিলেন সুজন বড়ুয়া। তাদের সহযোগী হিসেবে ছিলেন ম্যাক্স হাসপাতালের ২ জন কর্মচারীও।

তবে–সিভিল সার্জন কার্যালয়ে এদিনের ঘটনায় কারা জড়িত সিসিটিভি ফুটেজ থাকার পরও তাদের মুখোশ এখনো উন্মোচন করেননি খোদ সিভিল সার্জন ইলিয়াছ চৌধুরী নিজেই! অন্যদিকে এ ব্যাপারে বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয়ও কোন পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত গ্রহন করেনি বলে জানা গেছে।

এঘটনায় ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসকের দপ্তরের এক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে গত বুধবার এই কমিটি গঠন করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির আরও খবর দ্বিতীয় পর্বে দেখুন।

সকালের-সময় ডটকম

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ