আগ্রাবাদ গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাণ্ড 

থেমে নেই ময়নুলের অনিয়ম-দুর্নীতি, লাগাম টানবে কে!


মোহাম্মদ ফোরকান ৫ জুন, ২০২৩ ৬:১৮ : অপরাহ্ণ

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণপূর্ত বিভাগ প্রায় দুইশত বৎসর পূর্ব হইতে বাংলাদেশের সরকারী নির্মাণ জগতে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে আসছে। সারা বাংলাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামেও গণপূর্ত (ই/এম) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীগণের অফিস আছে। গণপূর্ত বিভাগ সৃষ্টির পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ সরকারী স্থাপনা সমূহ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নির্বাহী প্রকৌশলীদের মাধ্যমে সম্পাদিত হচ্ছে।

ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল (ই/এম) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীরা ভবন নির্মানের গুরুত্বপূর্ণ মালামাল কেনাকাটা করে থাকেন ঠিকাদার ও সাপ্লায়ারের মাধ্যমে। যেমন—অভ্যন্তরীণ বিদ্যুতায়ন, সাব স্টেশন, এইচভিএসি সিস্টেম, লিফট/চলন্ত সিড়ি, পানির পাম্প, আঙ্গিনার লাইট, আগুন সনাক্তকরণ ও সুরক্ষা ব্যবস্থা, ভবন নিরাপত্তা, ভবন অটোমেশন, মেডিকেল গ্যাস পাইপলাইন সিস্টেম, মঞ্চের আলোক ও শব্দ নিয়ন্ত্রন ও সমন্বয় ব্যবস্থা, কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং সিস্টেম, সৌর বিদ্যুৎ, ফোয়ারা ইত্যাদি।

কিন্তু—কতিপয় কিছু দুর্নীতিবাজ নির্বাহী প্রকৌশলীর কুনজরে গণপূর্তের বিভিন্ন প্রকল্পে হরিলুট হচ্ছে এমটাই বললেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রতি অর্থবছরে অনুমোদন পাওয়া প্রাক্কলিত অর্থ কাজে লাগাতে গোপনে কাগজ-কলমে দরপত্র আহ্বান দেখিয়ে কাজ সম্পন্ন দেখায় জুনের মধ্যেই। তা না হলে বরাদ্দ অর্থ সরকারের কোষাগারে ফেরত দিতে হবে। তাই গোঁজামিল করে, কখনও কাজ না করেই কাগজ-কলমে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিল দিয়ে দিচ্ছেন গণপূর্ত চট্টগ্রামের (ই/এম) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীরা।–এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গণপূর্ত চট্টগ্রাম (ই/এম) বিভাগের (ইকো ও মেকা) মালামাল ক্রয়ে টেন্ডার আহবান করে ঠিকাদারের মাধ্যমে কেনাকাটা করা হয়। কিন্তু গণপূর্ত চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ (ই/এম) বিভাগ-১ এর নির্বাহী এস এম ময়নুল হকের বিরুদ্ধে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কাজের ২০-৩০ শতাংশ টাকা নিয়ে কাজ না করে বিল দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি—চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপনের জন্য টেন্ডারে উল্লেখিত ক্যাটালকের লিফট না এনে ভিন্ন কোম্পানির লিপট নিয়ে আসে ঠিকাদার, যা পরবর্তীতে আর কোনো কাজে আসেনি লিফটি। তখন চট্টগ্রাম গনপূর্ত (ই/এম) বিভাগ-১ নির্বাহী প্রকৌশলী মঈনুলসহ বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে দেড় কোটি আত্মসাৎ করেন। আর এর মধ্য দিয়ে জলে যায় সরকারের প্রায় দেড় কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম (ই/এ) বিভাগ-১ এর বেশিরভাগ দরপত্রে ময়নুল সিন্ডিকেটভুক্ত ঠিকাদার অংশ নিয়েছেন, যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে।অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে অনুমোদন পাওয়া এ কাজ শেষ না করেই বিল পরিশোধের সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছেন তিনি। শুধু এটা নয়, এভাবে গত ২০১৯ সাল থেকে মে ও জুন মাসে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকারও বেশি কাজের প্রাক্কলন, যার অধিকাংশই নামমাত্র কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে বিল পরিশোধ করা হয়েছে।

আরও জানা যায়, টেন্ডারের পর কাজের মোটমূল্যের ৩০ শতাংশ টাকা ঠিকাদারদের কাছ থেকে নিয়ে কাজ সম্পন্ন দেখায়। এ ছাড়া একই কাজ একাধিক নামে করিয়ে বিল দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অনেক ক্ষেত্রে ঠিকাদাররা জানেনও না তারা কোথায় কাজ করেছে বা আদৌ কাজ হয়েছে কি না। এসব কারণে (ই/এম) বিভাগের কাজ নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানায়—এলটিএমের ক্ষেত্রে প্রতি টেন্ডারে ১০ শতাংশ কমে দর জমা পড়ে। এর মধ্যে লটারির মাধ্যমে কাজ দেওয়া হয়। এতে সরকারের শিডিউল বেশি বিক্রি হওয়ায় সরকারি কোষাগারে টাকা জমা হওয়ার পাশাপাশি ১০ শতাংশ কমের কারণে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হয়। কিন্তু—নির্বাহী প্রকৌশলী ময়নুল তার মনোনীত ব্যক্তিদের প্রাক্কলিত মূল্যে কাজ দেওয়ায় সরকারের ১০ শতাংশ হ্রাসের অর্থ লোকসান হচ্ছে। তবে এই ১০ শতাংশ টাকা প্রকৌশলী এবং ঠিকাদার ভাগ করে নেন তাদের নির্ধারিত কমিশনের বাইরে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এভাবে মে ও জুন মাসে তড়িঘড়ি করে গণপূর্ত চট্টগ্রাম (ই/এম) বিভাগ-১ ও ২ এর অধীনে কোটি কোটি কোটি টাকারও বেশি খরচ দেখানো হচ্ছে ইলেকট্রিক ও মেকানিক্যাল মালামালসহ আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে।

অভিযোগ রয়েছে, গণপূর্ত চট্টগ্রাম (ই/এম) বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ময়নুল হক ঠিকাদারদের কাছ থেকে ৫ শতাংশ হারে টাকা নিয়ে প্রাক্কলিত দর অনুযায়ী কাজ দিয়েছেন। পিপিআর অনুযায়ী এলটিএম (লিমিটেড টেন্ডারিং মেথড) পদ্ধতিতে দরপত্র হওয়ার কথা থাকলেও তা না করে ওটিএমের মাধ্যমে টেন্ডার আহ্বান করে কাজ দেওয়া হয়েছে।

টেন্ডার আইডি হাইড করে রেখে যাদের কাছ থেকে টাকা নিত পরে তাদের আইডি ও রেট জানিয়ে দিত বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা। তাদের দাবি, পিপিআর অনুযায়ী ইজিপিতে এলটিএমের বাইরে দরপত্র আহ্বানের সুযোগ নেই।

এদিকে অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে এসে কয়েকদিন আগে ই/এম গণপূর্ত বিভাগ-১ও ২ এর জন্য চট্টগ্রামের ৩৬ বাড়ি ও চৌদ্দ বাড়ীর বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং ও সুইচ, গার্ডেন লাইট ও সিকিউরিটি লাইটের জন্য ও ইমার্জেন্সি ব্লকে এসির জন্য জন্য, প্রশাসনিক ব্লকে ভিআরএফ এসির জন্য কয়েক শত কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, তিনি কাগজ-কলমে বিভিন্ন সরঞ্জাম ক্রয়ের নামে অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে কোটি কোটি কোটি টাকার বিল পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি বেশি কাজের চাহিদা দিয়ে চলতি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দও পেয়েছেন প্রায় অর্ধকোটি টাকা।

অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে আগ্রাবাদ গণপূর্ত (ই/এম) বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ময়নুল হকের অফিসে গিয়ে সরাসরি যোগাযোগ করা হলে তিনি তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তখন তিনি ধুমপান অবস্থায় প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন। অফিসে বসে এভাবে প্রকাশ্য ধুমপান করার নিয়ম আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি তখন প্রতিবেদকের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।

গণপূর্ত অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে স্থাপনা মেরামত বা বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা (এপিপি) খাতে গণপূর্ত অধিদফতরকে মোট ৮১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে স্থাপনা মেরামতের জন্য আবাসিক ভবনে ৫ হাজার ৯১২টি কাজের জন্য ৪০৫ কোটি এবং অনাবাসিক ভবনে ৬ হাজার ১৭৪টি কাজের জন্য ৪০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়।

বিষয়টি জানার জন্য তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর মুঠোফোনে কল দেয়া হলে তিনি কল রিসিভ করেনি।

প্রিয় পাঠক–ময়নুলের অনিয়ম-দুর্নীতি আরও ফিরিস্তি দ্বিতীয় পর্বে দেখুন।

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ