চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাফিয়া ডন কে এই প্রকৌশলী জসিম!


মোহাম্মদ ফোরকান  ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ ১:৩২ : পূর্বাহ্ণ

বন্দর নগরী চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ৭০ লাখ মানুষের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতকারী একমাত্র স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিতে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে।

চসিকের প্রকৌশল বিভাগের জোন-৪ এর বরপুত্র নির্বাহী প্রকৌশলী জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে এবার উঠেছে নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ। যদিও ইতিপূর্বে প্রকৌশল বিভাগের অনেকেই নানান অপকর্মের দায়ে অভিযুক্ত হলেও দীর্ঘদিন যাবত চসিকে সিদ্ধহস্ত নির্বাহী প্রকৌশলী জসিমের অনিয়ম ও দূর্ণীতি লেগেই আছে। এই যেন জসিমের বাপদাদার জমিদারি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ২০০৫ সালে অস্থায়ী সড়ক পরিদর্শক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হলেও অত্যান্ত চালাকচতুর জসিম খুব সহজে বুঝে নেন কিভাবে অস্থায়ী এই পদটি স্থায়ী করে নিতে হয়। যদিও সড়ক পরিদর্শক হিসেবে কাজে যোগ দেয়ার কথা থাকলেও জসিমের বিচরণ শুরু হয় সমগ্র সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি দপ্তরে।

খুব অল্প সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কি ভাবে ম্যানেস করতে হয় তা জসিমের আগে থেকেই জানা ছিল। তাই সবার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে সুনজরে আসেন এই দুর্নীতিবাজ জসিম। এর পর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চসিকের ঠিকাদারী ব্যবসা শুরু করেন তিনি। কথিত কয়েকজন ঠিকাদারের সাথে সখ্যাতা গড়ে তোলে জসিম ইতিমধ্যে আলাদীনের চেরাগ পেয়ে গেছেন। তিনি রীতিমতো আধিপত্য বিস্তার করে চলছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন জুড়ে।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতাদের তদবির এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুপারিশে নিয়ম ভেঙে পদোন্নতিও ভাগিয়ে নিয়েছেন এই দুর্নীতিবাজ জসিম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সহকারী প্রকৌশলী বলেন, সার্ভিস রুল বা চাকরির প্রবিধান অনুযায়ী উপ-সহকারী প্রকৌশলী থেকে পদোন্নতি পেয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী হতে কমপক্ষে যে সময় লাগে প্রকৌশলী জসিমের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। সম্প্রতি তিনি বড় কর্তাদের ম্যানেস করে স্থায়ী নির্বাহী প্রকৌশলীর অনুমোদন পেয়েছেন। যা নিয়ে অন্যান্য প্রকৌশলীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এছাড়া চসিকের ২৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের জন্য প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনা হলেও অনেকটা নিরবেই এই প্রকল্পের উপ-পরিচালক করা হয়েছে দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী জসিমকে। তিনিই একমাত্র প্রকৌশলী যে চসিকের প্রায় প্রতিটি বড় বড় প্রকল্পের উপ-পরিচালক হওয়ার অদৃশ্য যোগ্যতা রাখেন। বারবার প্রকল্পের উপ-পরিচালক হওয়ার বিষয়টা নিয়ে প্রকৌশল বিভাগে চলছে নানা গুঞ্জন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চসিকের অস্থায়ী সড়ক পরিদর্শক হিসেবে যোগদানের পর পারিবারিক ঠিকাদারী কাজেই করেছেন তিনি। তিনি একদিকে যেমন মোটা অংকের টাকা দিয়ে ভাগিয়ে নিয়েছেন পদোন্নতি সেই সাথে গড়ে তুলেছে অঢেল সম্পদের পাহাড়। আভিজাত এলাকায় আলিসান ফ্ল্যাট ও বিলাসবহুল অত্যাধুনিক নিশান এক্সট্রাইল মডেলের গাড়ি। তাছাড়াও নামে-বেনামে তার বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে ফ্ল্যাট ও প্লটের মালিকানা।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, জসিম নগরীর খুলশি এলাকায়ও বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ করছে। এই নির্মাণাধীন ভবনের মালিকানা সংক্রান্ত বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে চলছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।

তথ্যসূত্রে জানায়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ২৫০০ কোটি টাকার প্রকল্পের উপ-পরিচালক প্রকৌশলী জসিম তার ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম লিটনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফাহিমা কনস্ট্রাকশন’কে চসিক ৩৮ নং ওয়ার্ডের ২,২৭,৬৭,৪৩১.৪০ ( দুই কোটি সাতাশ লক্ষ সাতষট্টি হাজার চারশত একত্রিশ টাকা চল্লিশ পয়সা) টাকার ঠিকাদারি কাজ দিয়েছেন নিজের স্বাক্ষরিত কার্যাদেশে। এভাবে সরকারি চাকরিজীবী ভাইয়ের কর্মরত প্রতিষ্ঠানে ছোট ভাইয়ের ঠিকাদারি করার বিষয়টিকে বিধি ভঙ্গ ও স্বার্থের সংঘাত হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী, কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিবারের সদস্যরা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কোনো ব্যবসায়িক লেনদেন করলে তা অনুমোদনের সিদ্ধান্ত ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারী দিতে পারবে না। কিন্তু কথিত ঠিকাদার সাইফুল ইসলাম লিটনের ক্ষেত্রে প্রকল্পের উপ পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী জসিম উদ্দিন সরাসরি কার্যাদেশ দিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চসিক সংশ্লিষ্ট একজন ঠিকাদার বলেন, কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই এসব ভাইয়া প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়ে যায় সহজে, অথচ প্রকৃত ঠিকাদারদের কাজ পেতে নানান টালবাহানায় টাকা হাতিয়ে নেয় নয়তো স্লিপিং পার্টনারশীপ চুক্তিতে আনুপাতিক মুনাফার ভিত্তিতে কাজ নিতে হয়। এছাড়াও ইতিপূর্বে জোন-৪ এর নির্বাহী প্রকৌশলী জসিমের আওতাধীন চসিক ৯,১০,১১,১৩,২৬ নং ওয়ার্ডে চলমান বিভিন্ন কাজে তার ভাইদের অংশীদার করে যোগসাজশে ঠিকাদারি কাজ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন বিশাল অংকের টাকা।

এছাড়াও সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ১৭(৩) ধারা অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের অনুমোদন ছাড়া পরিবারের কোনো সদস্যকে তাঁর এখতিয়ারাধীন এলাকায় ব্যবসায় জড়িত হওয়ার অনুমতি দিতে পারেন না। কিন্তু প্রকৌশলী জসিম আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার ভাইদের কাজ দিয়েছেন।

নগরীর টোল রোডের আমীন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড নামের একটি অ্যাসফল্ট প্লান্টে রয়েছে প্রকৌশলী জসিমের বিশাল অংকের বিনিয়োগ যার পরিচালনার দায়িত্বে আছেন আরেক ছোট ভাই মোঃ দাউদুল ইসলাম দিদার। এছাড়াও দিদার নিজে একটি “মেসার্স ডিআইডি ট্রেডিং কর্পোরেশন” নামে সাপ্লাই প্রতিষ্ঠানের মালিক যেখানে যাবতীয় মুলধনের জোগান দাতাও প্রকৌশলী জসিম উদ্দিন।

সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব একটি অ্যাসফল্ট প্লান্টে রয়েছে সাগরিকা এলাকায় সেক্ষেত্রে অন্য অ্যাসফল্ট প্লান্টের মালামাল ব্যবহার করে সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব প্লান্টিকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্রের সামিল বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ এক প্রকৌশলী। প্রকৌশলী জসিম অ্যাসফল্ট প্লান্টের বিনিয়োগ করেছেন বলে জানান সিটি কর্পোরেশন একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।

এবিষয়ে জানতে নির্বাহী প্রকৌশলী জসিম উদ্দিনের মুঠোফোনে কল ও হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠালে তিনি প্রতিবেদকের মোবাইল নাম্বার ব্ল্যাক লিষ্টে দিয়ে দেন। এর পর অন্য নাম্বার থেকেও কল দেয়া হলেও তিনি নাম্বার বন্ধ করে দেন।

এই বিষয়ে জানতে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, চসিক নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল আলম ও চসিক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারাও কল রিসিভ করেনি।

প্রিয় পাঠক—দ্বিতীয় পর্বে দেখুন, কি ভাবে প্রকৌশলী জসিম উদ্দিন ও তার ভাইয়েরা বিদেশে শত-শত কোটি টাকা পাচার করেছে তার বিস্তারিত, সাথে থাকুন—ধন্যবাদ।

সকালের-সময় ডটকম

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ