এত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কি?


নিজস্ব প্রতিবেদক ২২ ডিসেম্বর, ২০২২ ১১:৪৯ : পূর্বাহ্ণ

দেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অমান্য করছে। বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত সিন্ডিকেট ও একাডেমিক সভা আহ্বান করে না। আচার্যের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ নেই। প্রতি বছর নিরীক্ষিত বার্ষিক হিসাবও দাখিল করে না। এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ স্পষ্ট লঙ্ঘন হচ্ছে।

এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাগাম টানতে ব্যর্থ সরকার। এজন্য আইন সংশোধন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাংকের মতো ট্রাস্টি বোর্ডে একজন সরকারি পর্যবেক্ষক রাখা প্রয়োজন বলে মনে করে দেশের উচ্চশিক্ষা তদারকি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

বর্তমানে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৯টি। এর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ৯৯টিতে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্ধেকের বেশি ঢাকায়। আটটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেলেও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেনি। আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

ইউজিসির সবশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ পাস হওয়ার পর ২০১২ সালে ১৬টি, ২০১৩ সালে ১০টি, ২০১৪ সালে ২টি, ২০১৫ সালে ৯টি, ২০১৬ সালে ৫টি, ২০১৮ সালে ৭টি, ২০১৯ সালে ২টি এবং ২০২০ সালে ৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয় সরকার।

২০০৬ সালে নানা অনিয়মের অভিযোগে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ও কুইন্স ইউনিভার্সিটির সাময়িক অনুমোদন বাতিল করে। পরে বন্ধ করে দেওয়া ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি এবং পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি আদালতের রায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে, শুধু রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য নিযুক্ত বৈধ উপাচার্যই মূল সনদপত্রে সই করতে পারেন। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সনদপত্রে সই করতে পারেন না। তবু বছরের পর বছর বৈধ উপাচার্য ছাড়াই চলছে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। দেওয়া হচ্ছে সনদও। আইনের বিধান মতে, সব ব্যয় ভাউচার, দেনা পরিশোধ, সব অর্থ লেনদেনে চ্যান্সেলর নিযুক্ত ট্রেজারারের সই থাকতে হবে।

বাস্তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈধ ট্রেজারার নেই। একাডেমিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে ও শিক্ষার মান বজায় রাখতে উপ-উপাচার্য থাকারও বিধান রয়েছে আইনে। দেশে শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও মাত্র ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য অনুমোদিত উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারারের পদ পূরণ করেছে।

উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার ছাড়াই দিব্যি চলছে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আদেশ, নির্দেশকেও পাত্তা দিচ্ছে না তারা। শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ৭৭টিতে উপ-উপাচার্য এবং ৪৮টিতে ট্রেজারারের পদ শূন্য।

তবে এর মধ্যে ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও ট্রেজারারের উভয় পদই খালি। ১০টিতে তিন পদেই কেউ নেই। শূন্য এসব পদ পূরণের জন্য নামের প্যানেল প্রস্তাব পাঠাতে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল সব বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেওয়া হয়। পরে ২৩ আগস্ট ফের তাগিদপত্র দেওয়া হয়।

আইন অনুযায়ী অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট দাখিল করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত সিএ ফার্ম থেকে সরকার মনোনীত একটি ফার্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব-নিরীক্ষা করাতে হবে। কিন্তু সিএ ফার্ম মনোনয়নের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবিত তিনটি ফার্মের মধ্যে সরকার একটি প্রতিষ্ঠানকে মনোনয়ন দেয়।

এ ক্ষেত্রে আর্থিক বিষয়ে প্রকৃত তথ্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব না নিয়ে শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিরপেক্ষ কোনো ফার্ম নিয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব নিরীক্ষা করানো যেতে পারে বলে ইউজিসির মত।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ও অর্থ কমিটির সভা করে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১২টিতে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, ২৪টিতে সিন্ডিকেট, ১৯টি একাডেমিক কাউন্সিল, ২২টিতে অর্থ কমিটির সভা হয়নি। আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও, জমি কেনার নামে ৩০৪ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক চার ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যকে জেলেও যেতে হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি কেনায় দুর্নীতি ছাড়াও প্রতি মিটিংয়ে মোটা অঙ্কের সম্মানি নেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি কেনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় ট্রাস্টিদের বিদেশ ভ্রমণ, ট্রাস্টি কোটা চালু করে শিক্ষার্থী ভর্তিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এত সংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দরকার নেই। হাতেগোনা ৫-৬টি ছাড়া অন্যগুলোতে কোনো লেখাপড়া হয় না। কেবল ছাত্র ভর্তি করে ক্লাস করায় আর সার্টিফিকেট বিক্রি করে। এতে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অভিভাবকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে যেসব শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে, তারা মেডিকেলে চান্স পান, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পায়, কৃষিতে চান্স পান আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও চান্স পান। কোথাও না কোথাও অথবা সব জায়গাতেই চান্স পান। আর যারা কোথাও চান্স পান না, তারা বাপ-মার কাছে কান্নাকাটি করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য জমি বিক্রি করেন। কারণ মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে জমি বিক্রি করা ছাড়া এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করানো সম্ভব নয়। ভর্তি হওয়ার পর সেখানে লেখাপড়া হয় না। ক্লাস হয়, পরীক্ষা হয় আর সার্টিফিকেট বিক্রি হয়। বিএ, এমএ পাস করার পর তখন আর কোথাও চাকরি পায় না।

বেকার জীবন শুরু হয়। এর পর অপরাধে জড়ায়। এতে পরিবার নিঃস্ব হয়, জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘এর সমাধান আছে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবার জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষা চালু করতে হবে। এর পর মেধার ভিত্তিতে এইচএসসিতে যাবে এবং উচ্চশিক্ষায় যাবে।

সূত্র—এসএ/এসএস/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ