আশ্রয়ন প্রকল্পের ভূমিহীনদের ঘর কেড়ে নিলো চেয়ারম্যান!


নিজস্ব প্রতিবেদক ১৪ নভেম্বর, ২০২৩ ৭:১৩ : অপরাহ্ণ

আমেনা বেগম (৬০)। তিনি পার্বত্য রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার ৩৭নং আমতলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান’র ‘মা’। এবার তাকে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর (ভূমিহীনদের জন্য বরাদ্দকৃত আশ্রয়ন প্রকল্প) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাকে।

শুধু ইউপি চেয়ারম্যান মজিবুরের মা আমেনা বেগম-ই নয়! একইভাবে ওই উপজেলার আমতলী ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল মালেক এর মেয়ে নূর বানু, ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বার আমির হোসেনের বোন নূর বানু ও ৮নং ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার দেলোয়ার হোসেনের বোন কবিতা আক্তারকে ভূমিহীনের এই ঘর বরাদ্দ দিয়েছে বাঘাইছড়ি উপজেলা প্রশাসন।

যদিও এই বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান বলেন, ভাই আমি এখানে এসছি নতুন। শুধু এতটুকুই বলবো, এসব ঘর হ’ল ভূমি ও আশ্রয়হীন মানুষের জন্য। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ও ভূমিমালিক এমন কাউকে এই ঘর বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ নাই।

স্থানীয়ারা জানান, বাঘাইছড়িতে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের ১২০টি ঘরের মধ্যে অধিকাংশই এখন বিত্তবান ও রেকর্ডধারী ভূমি মালিকদের দখলে। যদিও এসব ঘর ভূমি ও আশ্রয়হীন লোকদের জন্য উপহার হিসেবে প্রদানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। তবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুমানা আক্তারের সঙ্গে গোপন চুক্তিতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা নিজেদের স্বজনদের নামে এসব ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন।

এই বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে লিখিতভাবে অবিযোগ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন ( ট্রাস্ট) কেন্দ্রীয় সংসদ এর সদস্য ও বাঘাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক মো. রাসেল চৌধুরী। এই অভিযোগের তদন্তকরে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাঙামাটি জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে রহস্যজনক কারণে বিষয়টি ধামাচাপা পড়েছে বলে জানান অভিযোগকারী।

অভিযোগকারী রাসেল চৌধুরী জানান, আমতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে রেজিস্ট্রার্ড ভূমি মালিক ও আর্থিক স্বচ্ছল ব্যক্তিদের প্রধানমন্ত্রীর উপহারের (আশ্রয়ন প্রকল্পের) ঘর বরাদ্দ নিয়ে দিয়েছে। এই জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে ঘর নির্মাণের নামে সিমেন্ট ক্রয় করিয়ে নিয়েছেন।

অথচ এই উপজেলায় শতশত ভূমি ও আশ্রয়হীন মানুষ মানবেতন জীবন যাপন করছেন। এমনকি এখানে একটু আশ্রয়ের জন্য ভূমিহীন নারী-পুরুষ মিলে সমিতিও গড়ে তুলেছেন। এমন সব লোকজনকে বাদ দিয়ে রেজিস্ট্রার্ড ভূমি মালিক ও আর্থিকভাবে স্বচ্ছলদেরকে বিধিবর্হিভূতভাবে উপহারের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

রাসেলের অভিযোগ, শুধু বরাদ্দেই অনিয়ম হয়নি তা নয়! নির্মাণের ক্ষেত্রেও ব্যপক অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের নকশা পরিবর্তণ করে নিজেদেও খেয়ালখুশিমত ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। কোনো ঘরেই বাথরুম নির্মাণ করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠার পরই দায়সাড়াভাবে ১০টি রিং স্লাবের স্থানে তিনটি রিং দিয়ে কোনো কোনো ঘরের ভেতর/বাহিরে বাথরুম স্থাপন নির্মাণ করা হয়।

তাছাড়াও প্রতিজন উপকারভোগীর কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ বস্তা সিমেন্ট ও রড নেওয়া হয়েছে। অথচ সরকার প্রতিটি ঘরের জন্য প্রথম দফায় ১ লাখ ৭০ হাজার এবং দ্বিতীয় দফায় ২লাখ ৮০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দিয়েছে। শুধু রাসেলই নয়! এমন অভিযোগ করেছেন বাঘাইছড়ির স্থানীয় সচেতন একাধিক ব্যক্তি।

তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন আমতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান। তিনি বলেন, আমার সময়ে মোট ২৩টি ঘর দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে সবগুলোই ভূমিহীন ও অসহায় নিশ্চিত হয়েই দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, আমার সৎমা আমেনা বেগম। তাকেও একটি ঘর বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছিল। আমি তা বাতিল করে দিয়েছি। এছাড়া মেম্বার আবদুল মালেকের এক মেয়েকে গত বরাদ্ধে একটি ঘর দেওয়া হয়েছে। আর এক মেম্বারের বোন কবিতা আক্তার, সেও অসহায়।

তিনি উল্টো অভিযোগ করে বলেন, সাবেক চেয়ারম্যানের সময় ২৮টি ঘর এসেছে। সেই সময়কার চেয়ারম্যান স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ ৮জন নিকট আত্মীয়কে এই প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন। আমিতো এই বিষয়ে কাউকে কোনো সময় অভিযোগ বা সমালোচনা করিনি।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুমানা আক্তার বলেন, আমি এখান থেকে বদলী হয়ে চলে যাচ্ছি, এখন মিটিংয়ে আছি। আর বিষয়টি শুনলাম, আমি দেখবো।

রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন খান বলেন, প্রতিটি উপজেলায় উপহারের ঘর (আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর) এর উপকারভোগী ও প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি কমিটি রয়েছে। ইউএনওগণ হলেন এই কমিটির প্রধান। ঘর বরাদ্দ প্রদানে অনিয়ম করার ক্ষেত্রে পুরো কমিটি মিলেই করার কথা। অনিয়ম করার কথা নয়। এখানে কি হয়েছে আমি দেখছি।

সূত্র—পিসি/ এসএস/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ