বিষয় :

৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার চুক্তি বাতিল করল রেল


নিজস্ব প্রতিবেদক ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১০:১০ : অপরাহ্ণ

৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনায় দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে ২০১৮ সালের অক্টোবরে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চুক্তির ৬০ মাসের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহের কথা ছিল। তবে চার বছরেও ঋণচুক্তি হয়নি। বরং কঠিন শর্তের কারণে ঋণপ্রস্তাব বাতিল করে দেয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। পাশাপাশি হুন্দাইকে সহজ শর্তের ঋণ সংগ্রহের কথা জানায় রেলওয়ে। তবে সে শর্তে রাজি হয়নি কোম্পানিটি।

এদিকে তিন বছর পেরুনোয় ২০২১ সালে ইঞ্জিনের দাম ১৬ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করে হুন্দাই রোটেম। কিন্তু সে প্রস্তাবে সম্মত হয়নি রেলওয়ে। এতে চার বছর ঝুলে থেকে অবশেষে বাতিল হলো ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার চুক্তি। পাশাপাশি প্রজেক্ট গ্যারান্টি (পিজি) হিসেবে জমাকৃত এক লাখ ১৫ হাজার ডলার হুন্দাইকে ফেরত দিয়েছে রেলওয়ে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভায় এ তথ্য জানানো হয়। তবে চুক্তি বাতিল হলেও আপাতত প্রকল্পটি বাতিল করছে না রেলওয়ে। বরং ইঞ্জিনগুলো কেনায় সহজ শর্তের ঋণ খোঁজার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সভায়। এক্ষেত্রে প্রকল্পের অবশিষ্ট মেয়াদকাল অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে এ ধরনের ঋণ পেলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। অন্যথায় মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে প্রকল্পটি বাতিল করা হবে।

রেল সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির ২০১১ সালের আগস্টে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনা প্রকল্পটি অনুমোদন করে একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি)। সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করলেও একনেকে অনুমোদনের সময় সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট (সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ঋণের ব্যবস্থা করা) বা অন্য কোনো সহজ শর্তের উৎস থেকে ঋণ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

৭০টি ইঞ্জিনের মধ্যে ৩০টি সম্পূর্ণ ফিটিং অবস্থায় কেনার কথা ছিল। বাকিগুলোর মধ্যে ২৫টি অর্ধ-উন্মুক্ত (হাফ নকডাউন) ও বাকি ১৫টি পুরো উম্মুক্ত অবস্থায় (ফুল নকডাউন) কেনার কথা ছিল। এ ইঞ্জিনগুলো দেশে এনে রেলের নিজস্ব ওয়ার্কশপে সংযোজন করা হবে।

ইঞ্জিনগুলো কেনায় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর ও ২০১৩ সালের জুলাইয়ে দুই দফা দরপত্র আহ্বান করেও গ্রহণযোগ্য দরদাতা পাওয়া যায়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তৃতীয় দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে স্পেনের স্টেডলার রেল সর্বনিম্ন দরদাতা হয়। তবে কোম্পানির নাম পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় তাদের প্রস্তাবটি বাতিল করে দেয় সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।

এর পরিবর্তে দ্বিতীয় সর্বনিম্ম দরদাতা হিসেবে হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বাণিজ্যিক চুক্তি সই হয়। আর দরপত্রের সঙ্গে তাদের জমা দেয়া ঋণপ্রস্তাবটি নিয়ে দরকষাকষি ও ঋণচুক্তি সইয়ের ব্যবস্থা গ্রহণে ইআরডিতে পাঠানো হয় ওই বছর জুনে।

দরকষাকষির একপর্যায়ে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি ও আগস্টে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনমনীয় ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভায় প্রস্তাবটি নিয়ে দুই দফা আলোচনা হয়। পরে বিভিন্ন দপ্তরের মতামতের ভিত্তিতে গত বছর ৪ নভেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় ইআরডি। এতে বলা হয়েছে, কোরিয়ান কোম্পানি কর্তৃক প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য সরকার কর্তৃক এত উচ্চ হার সুদে অনমনীয় ঋণ গ্রহণের পরিবর্তে কোরিয়ান সরকারের নমনীয় উৎসের বা অন্য কোনো উৎসের নমনীয় প্রকৃতির ঋণ সংগ্রহ করা বাঞ্ছনীয় হবে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ নভেম্বর হুন্দাই রোটেমকে চিঠি দিয়ে সহজ শর্তের ঋণ সংস্থানের প্রস্তাব দেয়া হয়। তবে সে প্রস্তাবে অনাগ্রহ প্রকাশ করে হুন্দাই। এর পরিবর্তে চুক্তি বাতিল ও জমা দেয়া এক লাখ ১৫ হাজার ডলারের পিজি ফেরতের অনুরোধ করে কোম্পানিটি। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গত মার্চে পিআইসি সভা আহ্বান করা হয়। সে সভার সিদ্ধান্তক্রমে সিপিটিইউয়ের (সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট ইউনিট) মতামতের ভিত্তিতে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

সূত্র জানায়, সিপিটিইউয়ের মতামতের ভিত্তিতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে চুক্তি বাতিল ও পিজি ফেরত গ্রহণে গত ২৮ আগস্ট হুন্দাইকে চিঠি দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ সেপ্টেম্বর পিজি গ্রহণ করে হুন্দাই রোটেম। এদিকে গত আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পটির সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যা প্রকল্প ব্যয়ের মাত্র ০.২১ শতাংশ। এ অবস্থায় প্রকল্পটি বাতিল করা ঠিক হবে কি না বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়।

জানতে চাইলে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনা প্রকল্পের পরিচালক আহমেদ মাহবুব চৌধুরী বলেন, সিপিটিউয়ের মতামত ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে হুন্দাইয়ের সঙ্গে চুক্তিটি বাতিল করা হয়েছে। এরই মধ্যে কোম্পানিটি পিজি ফেরত নিয়ে গেছে। তবে এখনই প্রকল্পটি বাতিল করা হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার প্রকল্পের বর্ধিত মেয়াদকাল রয়েছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে প্রকল্পটির জন্য সহজ শর্তের ঋণ খোঁজা হবে। এজন্য ইআরডিকে শিগগিরই চিঠি দেয়া হবে। যদি সে ঋণ পাওয়া যায়, তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। অন্যথায় তা বাতিল করা হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে ইঞ্জিনগুলো কেনায় মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৯৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৬৫৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। তবে বর্তমান অবস্থায় ইঞ্জিনগুলো কিনতে গেলে ব্যয় বেড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

যদিও বর্তমানে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার প্রয়োজন নেই বলেই মনে করছেন রেলের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, ২০১০ সালে রেলের ইঞ্জিন সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল। তবে এরই মধ্যে রেলের বহরে ৪১টি মিটারগেজ ইঞ্জিন যুক্ত হয়েছে। এছাড়া নতুন করে কোনো মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে না। ফলে আগামীতে মিটারগেজ ইঞ্জিনের চাহিদা অনেক কমে যাবে। তাই ৭০টির পরিবর্তে ৩০টি ইঞ্জিন কিনলেই চলবে।

সূত্র—এসবি/এসএস/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ


You cannot copy content of this page