সকালেরসময় ডেস্ক :: বিশ্ব নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় বাংলাদেশের শীতলপাটিকে যুক্ত করেছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টা ৩২ মিনিটে এ স্বীকৃতির ঘোষণা দেন ইউনেস্কোতে রিপাবলিক অব কোরিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি লি পাইয়ংগ-হাইউন। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর জানিয়েছেন, নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য কমিটি শীতলপাটির বয়নপদ্ধতির স্বীকৃতি দিয়ে একে এ তালিকাভুক্ত করেছে।
এর আগে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা, বাংলার বাউলসঙ্গীত ও ঐতিহ্যবাহী জামদানি বুননপদ্ধতি ইউনেস্কোর এ তালিকায় যুক্ত হয়। এ ছাড়া গত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো।
সংশ্নিষ্ট দেশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে (ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ বা আইসিএইচ) যাচাই-বাছাই ও সুনির্দিষ্ট করে বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে তুলে ধরার কাজ করে ইউনেস্কো। এ-সংক্রান্ত সনদে স্বাক্ষর করা সব দেশ প্রতিবছর নিজেদের যে কোনো একটি উপাদানের স্বীকৃতি চেয়ে ইউনেস্কোতে আবেদন করতে পারে। এ বছর ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করে বাংলাদেশ।
স্বীকৃতিদানের মূল কাজ করে ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দি ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ। এ কমিটির দ্বাদশ সম্মেলন চলছে দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে। কমিটির আলোচ্যসূচির মধ্যে অন্যতম ছিল ২০১৭ সালের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকা অনুমোদন। এতে ২৪ সদস্যের মূল কমিটির বিবেচনায় পাঁচটি ক্যাটাগরির সবক’টিতে শতভাগ নম্বর পেয়ে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়। কমিটি এ ছাড়া ১৯টি দেশের ১৫টি নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছে আট সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। জাতীয় জাদুঘরের সচিব শওকত নবীর নেতৃত্বে এ প্রতিনিধি দলে রয়েছেন জাদুঘরের কিপার ড. শিখা নূর মুন্সী ও ডেপুটি কিপার আসমা ফেরদৌসী। প্র্যাকটিশনার হিসেবে সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন সিলেটের দু’জন প্রখ্যাত পাটিকর গীতেশ চন্দ্র দাশ ও হরেন্দ্র কুমার দাশ।
গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে ইউনেস্কো থেকে সুখবরটি আসার কিছুক্ষণ পর উল্লাস প্রকাশ করে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন ‘সমৃদ্ধ সংস্কৃতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে পরিচিতি ছিল, তা আরও একধাপ পোক্ত হলো শীতলপাটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে। এ জন্য আমরা গর্বিত।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের গর্ব করার মতো অনেক কিছু রয়েছে। পর্যায়ক্রমে বিশ্বদরবারে সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে শীতলপাটির স্বীকৃতি চাওয়া হয় ইউনেস্কোর কমিটির কাছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কাজে সার্বক্ষণিক দিকনির্দেশনা দিয়ে উৎসাহ দিয়েছেন। তার নির্দেশনা অনুযায়ী এসব কাজ করছি এবং একের পর এক সাফল্য পাচ্ছি।’
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘খুব শিগগির একটি আনন্দ আয়োজনের মধ্য বিরাট এই সাফল্য উদযাপন করা হবে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি এগিয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিকভাবে। এ অর্জন সত্যিই গর্বের।’
বিশিষ্ট ফোকলোর ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য কত গভীর, তা আরেকবার প্রমাণ হলো এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে।’ চিত্রশিল্পী হাশেম খান বলেন, ‘শুধু স্বীকৃতি পেলেই হবে না, এই শিল্পের ভবিষ্যৎও নিশ্চিত করতে হবে।’ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘এই হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সবাই নারী। প্রশিক্ষণ না থাকার পরও অসাধারণ সব বুনন করেন তারা। এই স্বীকৃতি তাদের উদ্বুদ্ধ করবে।’
লোকশিল্প-গবেষক চন্দ্রশেখর সাহা বলেন, ‘শীতলপাটি প্রয়োজনের তাগিদে এক বিস্ময়কর আবিস্কার। তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার এই তৃপ্তি নিয়ে বসে থাকলে হবে না। এ শিল্পকে সংরক্ষণ করার এবং এর কারিগরদের সার্বিক মানোন্নয়ন করার উদ্যোগ নিতে হবে।’
জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুর বলেন, ‘দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, শীতলপাটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাবে। ইউনেস্কোর নিয়ম ও শর্তগুলো বুঝে যথাযথভাবে অনুসরণ করে এর ফাইল তৈরি করে পাঠানো হয়। এটি সম্মিলিত উদ্যোগের ফসল।’
পাটিয়াল আরতি রানী দাশ বলেন, ‘বিদেশ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছি, এটা আনন্দের। কিন্তু পাটিকরদের জীবন-উন্নয়নের কোনো উদ্যোগ না নিলে এ স্বীকৃতি কোনো কাজে আসবে না।’