বিষয় :

ভাষা শহিদরা মরে গিয়ে হলো হিরো, আর আমরা হলাম জিরো: ভাষাসৈনিক ড. জসীম উদ্দিন


২০ মার্চ, ২০১৯ ৭:৫০ : পূর্বাহ্ণ

সকালেরসময় রিপোর্ট:: কেউ আমাদের খোঁজ-খবর নেন না। এমনকি ফেব্রুয়ারিতে অমর গ্রন্থমেলার উদ্বোধনীতেও আমাদের ডাকা হয় না। মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিতে ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর মিলনায়তনে কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের উদ্যোগে মরহুমের ১৩তম মৃত্যুবাষিকীর আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন ভাষাসৈনিক ড. জসীম উদ্দিন।

তিনি বলেন, ভাষা শহিদদের আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। তাদের সম্মান করছি। কিন্তু যে কথাটি কেউ স্মরণ করে না তা হচ্ছে ভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে। যারা জীবিত আছে। তাদের কোন খোঁজ-খবর রাষ্ট্র রাখে না। ভাষা শহিদরা সাধারণত বড় কোন নেতা ছিলেন না। আমরা তাদের জীবনদানকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ভাষাসৈনিকদের কথাও তো স্মরণ করতে হবে।

ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরের নির্বাহী পরিচালক এম আর মাহবুবের উপস্থাপনায় এতে বক্তব্য রাখেন একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক ড. শরিফা খাতুন, ভাষাসৈনিক মো. রেজাউল করিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিস, ভাষা আন্দোলন স্মৃতিরক্ষা পরিষদের মহাসচিব ডা. মোক্তাদির হোসেন, জিয়াউল হক, মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস এর আহ্বায়ক ফারুক আহমাদ আরিফ প্রমুখ।

তিনি বলেন, কাজী গোলাম মাহবুবের জীবন ও কর্মসহ ভাষাসৈনিকদের জীবনী পাঠ্যসূচিভুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমরা সাক্ষাৎ প্রত্যাশা করছি। ভাষাসৈনিক ড. শরিফা খাতুন বলেন, কাজী গোলাম মাহবুবের দূরদর্শীতার কারণেই ভাষা আন্দোলন ভিন্ন ধরনের গতি পায়। আর এদেশটি স্বাধীন হয়েছিল মূলত বৈষম্যের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণেই। তিনি বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শুধু ভাষাই নয় অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাসহ সকল ধরনের বৈষম্যই ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে কাজ করেছে।

তরুণদের দেশসেবায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা তরুণ বয়সেই ভাষা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম। আন্দোলন কিন্তু আজো শেষ হয়নি। রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি।ভাষাসৈনিক মো. রেজাউল করিম বলেন, কাজী গোলাম মাহবুব ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের পুনরায় প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমরা ভাষাসৈনিকরা হারিয়ে গিয়েছিলাম তিনি একত্রিত করছেন। আন্দোলনের স্মৃতিচারণ ও প্রচার এবং প্রসারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি।

মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিস বলেন, ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের বিজয়ের পেছনে কাজ করেছে মুসলিম জাতিয়তাবাদ। ভাষা আন্দোলনে কাজ করেছে বাঙালি জাতিয়তাবাদ। এই ভাষা আন্দোলনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ দেখিয়েছে কিন্তু দুঃখের বিষয় বাঙালি ইতিহাসকে একপেশে করে ফেলে। সঠিক ইতিহাস সামনে আনতে পারে না। আনে না। এটি এক নেতার প্রাধান্য তৈরি করে।

তিনি বলেন, দেব-দেবির যেমন বাহন প্রয়োজন তেমনি রাজনীতিতে আবেগী কর্মীর প্রয়োজন। কিন্তু আফসোস কর্মীদের কেউ মনে রাখে না। মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ১৯৬২ সালের আন্দোলনের মূলে ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতারের প্রেক্ষাপট। তাকে মুক্ত করার জন্যই সেই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল শিক্ষার কথাটি সামনে রাখা হয় মাত্র।

ডা. মোক্তাদির হোসেন বলেন, বাংলাদেশে বাংলা নেই এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন যে কারণে হলো সেই আন্দোলনের কর্মীদের সৈনিকদের কোন খোঁজ কেউ রাখে না। শহীদ জিয়াউল হক বলেন, কাজী গোলাম মাহবুবের আত্মজীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের সংকটের চেয়ে ইতিহাসের সংকট দুঃখজনক। ২১ ফেব্রুয়ারিতেও কাজী গোলাম মাহবুবের নাম উচ্চারিত হয় না এটি কত বড় জাতীয় সংকট!

ফারুক আহমাদ আরিফ বলেন, বাতাসের গতিপথ রোধ করা যায় কিন্তু আন্দোলনের গতিপথ রোধ করা যায় না। কাজী গোলাম মাহবুবু ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে ছিলেন কারণ তার চিন্তা ছিল আন্দোলনকে তৃণমূলে পৌঁছে দেয়া। তিনি বলেন, কাজী মাহবুবের পিতা কাজী আবদুল মজিদ ছিলেন কৃষক আন্দোলনের বরিশালের প্রতিষ্ঠাতা নেতা। তাই তার রক্তে আন্দোলনের স্রোত ছিল যা পরবর্তী অনেক আন্দোলনে কাজী মাহবুবের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

অনুষ্ঠানের শুরুতে এম আর মাহবুব কাজী গোলাম মাহবুবের সংক্ষিপ্ত জীবনী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কাজী গোলাম মাহবুব ১৯২৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশালের গৌরনদী থানার কসবা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি বরিশালের টরকী বন্দর ভিক্টোরী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলান পাশ করে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ শিক্ষা অর্জনের জন্য গিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে কলেজের ছাত্র পরিষদে ভিপি নির্বাচিত হন।

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলএম ছাত্র হিসেবে আইন পরিষদে ভর্তি হন। কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র এডভোকেট ছিলেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি শেখ মুজিবুর রহমান, খালেক নওয়াজ খান, শামসুল হকসহ অন্যান্য ছাত্রনেতাদের সাথে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

৩০ জানুয়ারি ১৯৫২ যখন, সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মীপরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়, কাজী মাহবুবকে সেটার আহ্বায়ক হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারির আমতলা সভায় কাজী মাহবুব উপস্থিত ছিলেন এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সমাবেশে যোগদান করেন।‌ পরে তিনি গ্রেফতার হন এবং এক বছর কারাগারে অতিবাহিত করেন। ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ তিনি ইন্তেকাল করেন।

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ


You cannot copy content of this page