মোহাম্মদ ফোরকান চট্টগ্রাম:: ত্রুটিপূর্ণ লাইসেন্সে অদক্ষ-অনভিজ্ঞ ডাক্তার-নার্স দ্বারা পরিচালিত নগরীর মেহেদিবাগের বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছে র্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত। রোববার (০৮ জুলাই) সকালে অভিযানে নেতৃত্ব দেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম। অভিযানে আরো নেতৃত্ব দেন ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি ডা. দেওয়ান মো. মেহেদি হাসান, ঔষুধ প্রশাসন চট্টগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক গুলশান জাহান প্রমুখ।
আর এই দিকে রোববার (০৮ জুলাই) নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকায় নিজ বাসায় শিশু রাইফার মৃত্যুতে গভীর সমবেদনার পাশাপাশি চিকিৎসকের অবহেলায় তার অকাল মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না মর্মে দায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়, সে বিষয়ে বিএফইউজে প্রচেষ্টা চালাবে। রাইফার নামে একটি ফাউন্ডেশন গঠন করা হবে। ফাউন্ডেশনটি চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন ও চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব যৌথভাবে পরিচালনা করবে। অসচ্ছল সাংবাদিকদের অসুস্থ সন্তানদের চিকিৎসায় এ ফাউন্ডেশন থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে বলে ও জানান মনজুরুল আহসান বুলবুল।
সম্প্রতি দৈনিক সমকালের ক্রাইম রিপোর্টার রুবেল খানের মেয়ে রাইফা খানকে ভূল চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের অবহেলাতেই মৃত্যুর পর পর সাংবাদিকদের আন্দোলনের মুখে দ্রুত চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি গত বৃহস্পতিবার রাতে এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে অবহেলায় শিশুর মৃত্যুর সাথে সম্পৃক্ত ডা: বিধান রায় চৌধুরী, ডা: দেবাশীষ সেনগুপ্ত, ডা: শ্রুভ্র দেবকে যথাযথ শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে শিশু বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি পাঁচ দিন তদন্তের পর এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান করে। শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে সিইউজের নেতৃবৃন্দ বলেন, ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং চিকিৎসকদের অবহেলাতেই আমাদের সহকর্মীর মেয়ে রাইফার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, রাইফার মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে রাইফার পিতা-মাতা যে অভিযোগ করেছিলেন তার সত্যতা পাওয়া গেছে। রাইফা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তার রোগ নির্ণয় ও ঔষধ প্রয়োগ যথাযথ থাকলেও রাইফা যখন খিচুনিতে আক্রান্ত হয় তখন চিকিৎসকের অনভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। ওই সময় সংশ্লিষ্ট নার্সদের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলার দক্ষতা ও জ্ঞান তাদের ছিল না।
ম্যাক্স হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ভর্তি ও চিকিৎসা শুরুর প্রতিটি ক্ষেত্রে রাইফার অভিভাবকদের ভোগান্তি চরমে ছিল। শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. বিধান রায় চৌধুরী শিশুটিকে যথেষ্ট সময় ও মনযোগ সহকারে পরীক্ষা করে দেখেননি। রোগ জটিলতায় বিপদকালীন সময়ে আন্তরিকতার সাথে সেবা প্রদান করেননি বলে রাইফার পিতা-মাতা যে অভিযোগ করেছেন, তা সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ম্যাক্স হাসপাতালে ভোগান্তি অনেক চরমে। চিকিৎসক ও নার্সদের সেবা প্রদানের সমন্বয় নেই, অদক্ষ নার্স ও অনভিজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগের ফলে এই হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না রোগীরা।
প্রতিবেদনে চারটি সুপারিশ করা হয়। তা হলো-
চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত তিনজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ম্যাক্স হাসপাতালের সার্বিক ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা অতিদ্রুত সংশোধন করা অপরিহার্য। কর্তব্যরত নার্সগণ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ডিপ্লোমাধারী থাকার নিয়ম থাকলেও উক্ত হাসপাতালে তা নেই। ডিপ্লোমা নার্স দ্বারা চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সার্বক্ষণিক দ্রুত ও আন্তরিক সেবা সুনিশ্চিত করতে হবে এবং রোগীর অভিভাবককে যথাসময়ে রোগীর অবস্থা ও চিকিৎসার ব্যাপারে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবগত করতে হবে।
তদন্ত প্রতিবেদনে চিকিৎসা প্রদানকারী শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. বিধান রায় চৌধুরীসহ চিকিৎসায় অবহেলার দায়ে তিনজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়। তদন্ত কমিটিতে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ছাড়াও অন্য দুই সদস্য হলেন- চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক সবুর শুভ। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা: আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন: আমরা তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মহাপরিচালকের কাছে প্রেরণ করেছি। এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ ব্যাপারে পরবর্তী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ম্যাক্স হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা: মোহাম্মদ লিয়াকত আলী খান ডেসটিনিকে বলেন, অবহেলায় সাংবাদিক রুবেল খানের মেয়ের মৃত্যুর অভিযোগ আসার পর আমরাও নিজস্ব একটি তদন্ত কমিটি গঠন করি। ওই তদন্তে ডা: দেবাশীষ সেন গুপ্ত ও ডা: শুভ্র দেবের অবহেলার বিষয়ে প্রমাণ পাই। তাই ওই দুজনকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বহিষ্কার করেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে ডা.বিধান রায় চৌধুরীর নাম ও আসায় তাকেও হাসপাতালে রাখবো কি রাখবো না কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ২৯ জুন চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে সামান্য গলা ব্যথা নিয়ে ভর্তি হওয়া সাংবাদিক কন্যা রাইফা খান চিকিৎসকদের অবহেলায় মারা যায়। এই ঘটনায় দোষী চিকিৎসকদের বিচার দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রামের সর্বস্তরের সাংবাদিকরা।