হরিলুটের দপ্তর সিডিএ–প্রকল্প মানেই মাস্তি-ফুর্তি বিদেশে আনন্দ ভ্রমন!


নিজস্ব প্রতিবেদক ৩ অক্টোবর, ২০২৩ ১১:২১ : পূর্বাহ্ণ

আবাসন সংকট নিরসনে ২০১৭ সালে ‘অনন্যা আবাসিক এলাকার উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। প্রকল্পটির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর করেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিবসহ ৫ কর্মকর্তা। এতে সিডিএর ব্যয় হয় ১ কোটি ৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকার বেশি। অথচ সিডিএ এখন বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়! প্রকল্পটি বাতিল করতে চিঠিও পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে।

এভাবে সিডিএর ছয়টি প্রকল্পের অধীনে ৩৪ জনের বিদেশ সফরের তথ্য মিলেছে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে, যাদের ২৩ জনই প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন। বিদেশ সফরকারীর ওই তালিকায় রয়েছেন সিডিএর বোর্ড সদস্য, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি। তারা যুক্তরাষ্ট্র-কানাডাসহ ১৪টি দেশ সফর করেন। এসব সফরের খরচ বহন করে সিডিএ এবং পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে এসব সফর হলেও এগুলো মূলত ছিল ‘আনন্দ ভ্রমণ’ যার মাধ্যমে বিপুল অর্থের অপচয় হয়েছে। অথচ অনেক প্রকল্পের বাড়তি খরচ মেটাতে সিডিএ আরোপ করছে টোল।

বিদেশ ঘুরে আসার পর প্রকল্প বাতিল

২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন হয় সিডিএর ‘অনন্যা আবাসিক এলাকার উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্প। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা।

প্রকল্পের অধীনে ২০১৮ সালের ৭ থেকে ১৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর করেন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার, পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের যুগ্ম প্রধান মো. মতিউর রহমান, পরিকল্পনামন্ত্রীর তৎকালীন একান্ত সচিব ফরিদ আজিজ, গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন আইন কর্মকর্তা এস এম মোস্তফা কামাল এবং সিডিএর ওই সময়ের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন চৌধুরী। তাদের মধ্যে মো. শহীদ উল্লা খন্দকার ২০২২ সালে এবং মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন চৌধুরী ২০১৯ সালে অবসরে গেছেন।

এই পাঁচজনের ১০ দিনের বিদেশ সফরে সিডিএর খরচ হয় ১ কোটি ৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬৫৬ টাকা। এর মধ্যে শহীদ উল্লা খন্দকার ও মো. মতিউর রহমান ভ্রমণ ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাবদ নেন ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৪৪১ টাকা করে। একই খাতে ফরিদ আজিজ, এস এম মোস্তফা কামাল ও মো. জসীম উদ্দিন চৌধুরী নেন ৩ লাখ ৩২ হাজার ৫৯১ টাকা করে। এ ছাড়া ভিসা ফি ও প্লেন ভাড়ায় ব্যয় হয় ৪১ লাখ ৬২ হাজার টাকা। আর সেমিনার, সম্মেলন ও প্রশিক্ষণে ব্যয় হয় ৪৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রকল্পটির কাজ শুরু না হলেও কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর, জরিপ, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের খরচ, প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি (পিএসসি) ও প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটির (পিআইসি) সভার সম্মানী, মুদ্রণ, প্রকাশনা, স্টেশনারি, সিল ও স্ট্যাম্প ক্রয় বাবদ খরচ হয়ে গেছে ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

২০২২ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘লিভিং আর্কিটেক্ট লিমিটেড’। এ জন্য তারা নেয় ১৫ লাখ টাকা। সমীক্ষা শেষে দেওয়া প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ‘আর্থিক ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় প্রকল্পটি লাভজনক হবে না। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ২৩ মে ‘অনন্যা আবাসিক এলাকার উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্প বাতিল করতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি পাঠায় সিডিএ।

মন্ত্রণালয়েরে অতিরিক্ত সচিব মো. হামিদুর রহমান খান জানান, প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রকল্পই যদি না থাকে, তাহলে ইতোমধ্যে খরচ হওয়া ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা নির্বাহ হবে কোন খাত থেকে– এই প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি প্রকল্পটির পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী আহমদ মঈনুদ্দিন।

আর প্রকল্প সংশ্লিষ্ট না হয়েও ‘অনন্যা আবাসিক এলাকার উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্পের অধীনে বিদেশ সফরের বিষয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন আইন কর্মকর্তা ও বর্তমানে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (আইও) এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, ‘স্টাডি ট্যুরের জন্য মন্ত্রণালয়ের আদেশ হয়েছে, তাই গিয়েছি। ভ্রমণের জন্য কারা আমার নাম প্রস্তাব করেছে– এটা আমার জানার বিষয় ছিল না।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস এ ঘটনার দায় নিতে নারাজ। তিনি বলেন, প্রকল্পটি যখন হাতে নেওয়া হয়, তখন জমি অধিগ্রহণ ব্যয় ছিল মৌজা মূল্যের দেড় গুণ। এখন তা বেড়ে হয়েছে তিন গুণ। পরামর্শক নিয়োগ করে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হলে তারা জানায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়। তাই প্রকল্প বাতিল করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প চূড়ান্ত হওয়ার আগেই পাঁচ কর্মকর্তার বিদেশ সফর সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তাই এ বিষয়ে বলতে পারব না।

সিডিএর এই প্রকল্প চূড়ান্ত হওয়ার আগে বিপুল অর্থ ব্যয়ের যথার্থতা বিশ্লেষণ ও যৌক্তিকতা নিরূপণে গত জুলাইয়ে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান করা হয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হামিদুর রহমান খানকে।

কমিটির সদস্য হলেন– বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) উপপরিচালক মোহা. আকবর আলী, সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস এবং নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক আহমদ মঈনুদ্দিন। কমিটি এ পর্যন্ত দুটি সভা করেছে। সর্বশেষ সভা হয় গত ২৩ আগস্ট।

কমিটির প্রধান মো. হামিদুর রহমান খান বলেন, বিদেশ সফরে ব্যয়সহ পুরো প্রকল্পের ব্যয়ে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কমিটির এক সদস্য দেশের বাইরে ছিলেন, তাই একটু দেরি হয়েছে। আমরা শিগগির আরেকবার বসব। এরপর প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দেওয়া হবে।

ঘটনাটি তদন্ত হচ্ছে জানিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আগে কীভাবে পাঁচজন বিদেশ গেলেন, এত টাকা কীভাবে খরচ হলো, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। অনিয়ম প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেন, প্রশিক্ষণের নামে প্রকল্পের বাইরের লোকজন যে আনন্দ ভ্রমণে যান– এই প্রকল্প তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যারা বিদেশ গেছেন তারা যেমন দোষী, যারা অনুমোদন দিয়েছেন তারাও সমান দোষী।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট না হয়েও গেলেন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড

চট্টগ্রাম নগরীর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণ করছে সিডিএ। প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল একনেকে অনুমোদন হয়। এই প্রকল্পের অধীনে ২০১৮ সালে ১০ দিন অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সফর করেন ৬ জন।

তারা হলেন– গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) এস এম আরিফুর রহমান, সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, সিডিএর সাবেক সচিব তাহেরা ফেরদৌস বেগম, পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান রবীন্দ্র নাথ বর্মণ, নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনজুর হাসান ও সহকারী প্রকৌশলী আবুল হাসনাত মো. মেজবাহ উদ্দীন।

তারা কেউই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন। প্রকল্পটির পরিচালক হলেন সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব দাশ ও উপপ্রকল্প পরিচালক সহকারী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম। ওই ছয়জনের বিদেশ সফরে ব্যয় হয় ৮৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা এবং পুরোটাই গেছে সরকারি তহবিল থেকে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। ২০২০ সালের জুনে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। পরে দুই দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়। ব্যয় বেড়েছে ৮০০ কোটি টাকা। বর্তমানে এই প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। কাজ শেষ হয়েছে ৬৫ শতাংশ।

অভিজ্ঞতা থাকার পরও বিদেশ সফর

চট্টগ্রাম নগরে তিনটি ফ্লাইওভার ও একটি ওভারপাস নির্মাণের অভিজ্ঞতা রয়েছে সিডিএর। এই অভিজ্ঞতা থাকার পরও লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অধীনে গত মে মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চীন সফর করেন সিডিএর সচিব মোহাম্মদ মিনহাজুর রহমান, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এএএম হাবিবুর রহমান ও প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান। তাদের আট দিনের ওই বিদেশ সফরের ব্যয় বহন করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র‍্যাঙ্কন (জেভি)।

অভিজ্ঞতা অর্জনে সিডিএর কর্মকর্তারা বিদেশ সফর করলেও প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন হয়েছে তিন দফা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দফায় দফায় আপত্তির মুখে পড়ে সিডিএ। প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৪৮ কোটি ১২ লাখ টাকা, এখন কাজ শেষ পর্যায়ে। ভৌত অগ্রগতি ৮৪ শতাংশ। আগামী ২৮ অক্টোবর প্রকল্পটি উদ্বোধনের কথা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, কোনো প্রকল্পে ঠিকাদার বিদেশ ভ্রমণের খরচ বহন করার অর্থ এই নয় যে, জনগণের করের টাকা ব্যয় হচ্ছে না। ঠিকাদার ওই ব্যয় বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান থেকেই আদায় করে। দিনশেষে এর খেসারত জনগণকেই দিতে হয়।

বিদেশ সফরে বোর্ড সদস্যরাও

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৮ অনুযায়ী, ভূমির যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ ২০টি কাজ করার এখতিয়ার রয়েছে বোর্ড সদস্যদের। তবে বাস্তবে বোর্ড সভায় অংশ নেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো ভূমিকা তেমন দেখা যায় না। সিডিএর বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর সঙ্গেও তাদের তেমন কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

এর পরও চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড প্রকল্পের অধীনে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ঘুরে এসেছেন বোর্ড সদস্য স্থপতি সোহেল এম শাকুর, কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দীন ও হাসান মুরাদ বিপ্লব। এ ছাড়া এই প্রকল্পের অধীনে বিদেশ সফর করেন প্রকল্প পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস, উপপ্রকল্প পরিচালক রাজীব দাশ, তৎকালীন প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান, নির্বাহী প্রকৌশলী আহমদ মঈনুদ্দিন, উপসচিব অমল গুহ এবং প্রধান অর্থ ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজের।

তাদের ১২ দিনের বিদেশ সফরে ব্যয় হয় ৭৮ লাখ ৫১ হাজার টাকা। প্রকল্পটি অনুমোদন হয় ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। এক যুগে প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। এটি সংশোধন হয়েছে চারবার। ৮৫৬ কোটি টাকার এই প্রকল্পে এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।

এদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ এই প্রকল্পে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে। তাদের ‘নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন’-এ বলা হয়েছে, ফিডার রোড-২, সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস রোড নির্মাণ করা না হলে প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ সুফল মিলবে না ও এলাকাবাসীর যাতায়াতে অসুবিধা হবে। প্রতিবেদনে ওইসব সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া খালের সঙ্গে নির্মিত স্লুইসগেটগুলোর সংযোগ নেই বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। যার ফলে নতুন করে জলাবদ্ধতা হচ্ছে প্রকল্পভুক্ত এলাকার আশপাশে।

বিদেশে অভিজ্ঞতা নেওয়ার পরও ডুবছে নগরী

‘চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন’ প্রকল্পে পরিচালকের (পিডি) দায়িত্বে আছেন সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী আহমদ মঈনুদ্দিন। তিনি ২০১৯ সালে ৯ দিন ব্রাজিল ও ৪ দিন পানামা সফর করেন। এই প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক কাজী কাদের নেওয়াজও যান পানামায়। সহকারী প্রকল্প পরিচালক হামিদুল হক সফর করেন চীন।

সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া তড়িঘড়ি হাতে নেওয়া সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটির এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। কর্মকর্তারা অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিদেশ ঘুরে এলেও একটু বৃষ্টিতেই ডুবছে চট্টগ্রাম নগরী। দুই দফায় প্রকল্পের সময় বেড়েছে তিন বছর। আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৮৭ শতাংশ।

প্রকল্পের ধীরগতিতে ব্যবস্থা না নিয়ে ‘প্রণোদনা’

২০১৮ সালে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনা ছিল, কোনো প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি জাতীয় গড় অগ্রগতির বেশি হলে প্রকল্প পরিচালকদের বিদেশ ভ্রমণসহ নানা প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। আর অগ্রগতি কম থাকলে প্রকল্প পরিচালকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্পের অগ্রগতি কম থাকার পরও বিদেশ সফর করেন সিডিএর প্রকল্প পরিচালকরা। যেসব প্রকল্পের অধীনে মন্ত্রণালয় ও সিডিএ কর্মকর্তারা বিদেশ গেছেন, সেগুলোর কোনোটিই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। দফায় দফায় ব্যয়ও বেড়েছে।

২০১১ সালে তিনটি বহুতল ভবন (২০, ২২ ও ২৫ তলা) নির্মাণে ‘কনস্ট্রাকশন অব সিডিএ স্কয়ার অ্যাট নাসিরাবাদ’ প্রকল্প হাতে নেয় সিডিএ। এক যুগেও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর পরই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইতালি সফর করেন গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং সিডিএর আট কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী।

তাদের মধ্যে সাতজনের প্রকল্পের সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তারা হলেন– পরিকল্পনা কমিশনের তৎকালীন ভৌত অবকাঠামো বিভাগের যুগ্ম প্রধান এস এম জহির খান, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব মো. খলিলুর রহমান ও একই মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের তৎকালীন উপপ্রধান মোহাম্মদ জালাল আহমেদ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিশ্লেষক মোখলেছুজ্জামান।

আর সিডিএর চার নির্বাহী প্রকৌশলী হলেন–মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, আহমদ মঈনুদ্দিন, মুহাম্মদ শাহাবুদ্দীন খালেদ ও মো. শামীম। এই সফরে সিডিএর ব্যয় হয় ৬৮ লাখ টাকা। ‘অভিজ্ঞতা অর্জনে’ কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণ করলেও প্রকল্পটির কাজে অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। ২০১৮ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও পরে সময় বাড়ানো হয় ২০২৩ সাল পর্যন্ত। এক যুগে প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ।

বাড়তি ব্যয় মেটাতে টোল

এক দশক আগে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সিডিএ। দুই বছরের নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারায় দুই দফা বাড়ে নির্মাণ ব্যয়। ১৭২ কোটি টাকার প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে এখন হয়েছে ৩৫৩ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত বছরে ৩৩ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ে। বাড়তি এই অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে সরকার।

ফলে প্রকল্পের ব্যয় সংস্থানে সড়কটিতে টোল আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিডিএ। ছয় কিলোমিটারের এই সড়কে গাড়ির টোল হারও নির্ধারণ হয়েছে। কাজ শেষ হলেই টোল আদায় শুরু হবে। এ ছাড়া লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারকারী গাড়ির কাছ থেকে টোল আদায় হবে। ২৫ কোটি টাকায় ১২টি টোল প্লাজা নির্মাণে এরই মধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে। নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল অবকাঠামোর কাজ শেষ হলে টোল প্লাজা নির্মাণ হবে বলে জানিয়েছেন সিডিএ কর্মকর্তারা।

কেন এত বিদেশ সফর

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ছোট-বড় ১২টি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সিডিএ। এর মধ্যে গত এক যুগে বাস্তবায়ন হয়েছে ‘অনন্যা আবাসিক এলাকার প্রথম পর্যায়’ কল্পলোক আবাসিক এলাকার উন্নয়ন’ এবং ‘চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকার মতো আবাসিক এলাকা’ প্রকল্প।

একাধিক সড়ক, ফ্লাইওভার ও আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা থাকার পরও একই ধরনের প্রকল্পের জন্য কেন বিদেশ সফর প্রয়োজন হচ্ছে– জানতে চাইলে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘সিডিএ বাস্তবায়ন করেছে গতানুগতিক প্রকল্প।

স্মার্ট সিটির জন্য উন্নয়ন প্রকল্পে নতুন যে প্রযুক্তি উন্নত দেশগুলো ব্যবহার করছে–সেমিনার, প্রশিক্ষণে না গেলে আমাদের প্রকৌশলীরা তা জানতে পারবেন না। এ জন্য বিদেশ সফরের প্রয়োজন আছে। তবে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বিদেশ না গিয়ে অন্যরা গেলে সেটি সরকারি তহবিলের অপচয় ছাড়া কিছু নয়।

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া মনে করেন, যে ধরনের প্রকল্প সিডিএ হাতে নিচ্ছে, এগুলো বাস্তবায়নে বিদেশ যেতে হয় না। অনেক আধুনিক ও উঁচু ভবন দেশে অনেক আগে থেকে রয়েছে। তা ছাড়া বিদেশ গেলেও সেই অভিজ্ঞতা চট্টগ্রামের কোনো প্রকল্পে কাজে লাগাতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে প্রকল্পগুলোর সুফল মানুষ পাচ্ছে না।

মন্ত্রণালয় ও সিডিএ কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর প্রসঙ্গে প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, এগুলো স্রেফ আনন্দ ভ্রমণ, আর জনগণের টাকা নয়ছয়! এসব বন্ধ হওয়া উচিত। যারা বিদেশ যাচ্ছেন এবং যারা অনুমোদন দিচ্ছেন– উভয়েরই জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।

সূত্র—এসকে/সকালের-সময়/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ


You cannot copy content of this page