হাটহাজারীতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা

স্ত্রীসহ চার সন্তান হারিয়ে নিঃস্ব নারায়ণ, পাগলপ্রায় কাঞ্চন বালা


নিজস্ব প্রতিবেদক ৮ নভেম্বর, ২০২৩ ১১:০০ : পূর্বাহ্ণ

ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা কাঞ্চন বালা দাশ (৪৫) ও পঙ্গু শম্ভু দাশ। আর্তনাদ করছিলেন তারা। কখনো নির্বাক, কখনো চিৎকার করে কাঁদছেন। এ অবস্থায় সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাটুকুও কারো নেই।

এদিকে স্ত্রী রীতা রানী দাশ, দুই মেয়ে শ্রাবন্তী দাশ ও বর্ষা দাশ এবং যমজ দুই ছেলে দ্বীপ দাশ ও দিগন্ত দাশকে নিয়ে সাজানো–গোছানো সংসার ছিল প্রবাসী নারায়ণ দাশের। কিন্তু একটি সড়ক দুর্ঘটনা তছনছ করে দিল তার সাজানো সংসারটি। ঘাতক বাস মুহূর্তেই কেড়ে নিল তার স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ের তরতাজা প্রাণ। এখন তার পরিবারে আর কেউ নেই। একেবারে নিঃস্ব নারায়ণ দাশ। যা কখনো ভাবেননি তিনি।

শুধু নারায়ণ নন, এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার বড় ভাই পঙ্গু শম্ভু দাশের সংসারও। তার স্ত্রী, তিন ছেলের মধ্যে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে বিপ্লব দাশও (৩২) সে ও ঘটনাস্থলে নিহত হন। এতে তাদের সংসারের উপার্জনক্ষম আর কেউ রইল না।

মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) দিবাগত রাতে নিহতদের মরদেহ যখন চন্দনাইশ উপজেলার মোহাম্মদপুরের ধোপাপাড়ায় নিজ বাড়িতে আনা হয় তখন এই দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ সময় তাদের দেখতে আসা মানুষের চোখও ছিল অশ্রুসিক্ত।

উপজেলার জোয়ারা ইউনিয়রের চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ চৌধুরী রোকন বলেন, স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও নেই। আমরা নিহতদের শেষকৃত্য করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি।

চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ চৌধুরী রোকন বলেন, একই পরিবারের নিহত ৭ জনের মধ্যে নারায়ণ দাশের স্ত্রী, ফুটফুটে দুই কন্যা ও যমজ দুই পুত্র সন্তান রয়েছে। সবচেয়ে খারাপ লাগছে তার জন্য। সে কীভাবে এমন ঘটনা সহ্য করবে জানি না। সৃষ্টিকর্তা তাকে ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা দিক।

চেয়ারম্যান আরও বলেন, দুর্ঘটনায় জড়িত বাসের ওই চালককে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। এছাড়া যাতে আইনের ফাঁকে পার পেয়ে না যায় সেই ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান তিনি।

নাজিরহাট হাইওয়ে পুলিশের ওসি আদিল মাহমুদ জানান, ময়নাতদন্ত ছাড়া নিহতদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। দুর্ঘটনার বিষয়ে স্বজনদের পক্ষ থেকে একটি মামলার প্রক্রিয়া চলছে।

তিনি জানান, মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী–নাজিরহাট সড়কের মির্জাপুর ইউনিয়নের চারিয়া ইজতেমা মাঠ সংলগ্ন এলাকায় বাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে মর্মান্তিক মৃত্যুর এই দুর্ঘটনা ঘটে।

ঘটনায় নিহতরা হলেন— চন্দনাইশের জোয়ারা ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর ধোপাপাড়া এলাকার প্রবাসী নারায়ণ দাশের স্ত্রী রীতা রানী দাশ (৩৮), তার বাক্‌ প্রতিবন্ধী মেয়ে কাঞ্চনাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী শ্রাবন্তী দাশ (১৭), বর্ষা দাশ (৯), যমজ দুই সন্তান দ্বীপ দাশ (৪), দিগন্ত দাশ (৪), নারায়ণের বড় ভাই প্রতিবন্ধী শম্ভুর ছেলে বিপ্লব দাশ (৩২) ও নারায়ণের বোন সচীন্দ্র দাশের স্ত্রী চিনু দাশ (৫৫)।

এছাড়া নিহত চিনুর ছেলে বাপ্পা দাশ (৩২) সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক বিপ্লব মজুমদার (২৮) চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তার বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলার বৈদ্যারহাট এলাকায়। ঘটনার পর বাস চালক পালিয়ে যান। পুলিশ বাস ও দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া টেক্সিটি জব্দ করেছে।

নিহত রীতা রানীর বড় জা মল্লিকা দাশ জানান, ফটিকছড়ি উপজেলায় তার ছোট জা রীতার নানাবাড়ি। এক মাস আগে রীতার নানি মারা যান। মঙ্গলবার ছিল তার নানির শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান।

ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রীতার সঙ্গে পরিবারের অন্যরা ফটিকছড়ির শাহনগর গ্রামে মনোমোহন কবিরাজ বাড়িতে যাচ্ছিলেন। সকাল ৯টায় চন্দনাইশের বাড়ি থেকে বের হয়ে সিএনজি অটোরিকশায় (চট্টগ্রাম–থ–১৩–০২১৮) করে মইজ্যারটেক যান।

সেখান থেকে অপর একটি অটোরিকশায় আসেন নগরীর নতুন পাড়ায়। সেখান থেকে আরেকটি অটোরিকশায় ফটিকছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন।

অটোরিকশাটি হাটহাজারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের চারিয়া ইজতেমা মাঠ সংলগ্ন এলাকায় পৌঁছলে বিপরীত দিক থেকে আসা মারসা পরিবহনের চট্টগ্রাম শহরমুখী যাত্রীবাহী একটি বাসের (চট্টমেট্রো–ব–১১–১৮০৮) সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ৭ জন।

উপস্থিত লোকজন আহত বাপ্পা ও সিএনজি চালক বিপ্লবকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যান। আঘাত গুরুতর হওয়ায় তাদের চমেক হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।

চমেক হাসপাতালে আহত বাপ্পা দাশ বলেন, বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এরপর আর কিছু মনে নেই। পরে জ্ঞান ফিরলে নিজেকে হাসপাতালে দেখতে পাই।

নিহত বিপ্লব দাশের মা কাঞ্চনবালা দাশের আহাজারিতে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। তিনি বলেন, আমার তো সব শেষ। আমি কি নিয়ে বাঁচব?

স্থানীয়রা জানান, ১২–১৩ বছর আগে হাটহাজারীর ওই সড়কের মুন্সির মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় এক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ১৫ জন নিহত হয়েছেন।

এদিকে, দুর্ঘটনাস্থলে স্থানীয় অনেকে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নগরীর অক্সিজেন থেকে হাটহাজারী পর্যন্ত সড়ক চার লেইনের। সড়কের মাঝখানে ডিভাইডার আছে। হাটহাজারী থেকে ফটিকছড়ি পর্যন্ত সড়কটি সম্প্রসারণ করা হয়েছে। কিন্তু ডিভাইডার না থাকায় সড়কে ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এতে করে প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। এই সড়কে ডিভাইডারের দাবি জানান তারা।

এসএস/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ


You cannot copy content of this page