“রাখিব নিরাপদ দেখাব আলোর পথ” বাক্যটি এখন শুধুই শ্লোগান!


মোহাম্মদ ফোরকান ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ৫:২২ : অপরাহ্ণ

কারাগারের অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা আর নির্যাতনের কারণে অসন্তোষ বাংলাদেশে বহুলচর্চিত একটি বিষয়। তবে এর বাইরে কিছু অন্য চিত্রও আছে। সাধারণ লেখাপড়া, নৈতিক শিক্ষা আর হাতেকলমে কর্মমুখি শিক্ষার মাধ্যমে বন্দিদের আলোর পথও দেখায় চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ। জ্ঞান, দক্ষতা কাজে লাগিয়ে একজন অপরাধী জেলমুক্তির পর ইচ্ছে করলে সুপথে থেকেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারে।

কিন্তু কারাগার কর্তৃপক্ষের দাবি কারাগারের প্রতিটি বন্দিকে রাখা হয় সুন্দর পর্যবেক্ষণে। কঠোর নিরাপত্তা ও ভালো আচরণে মাধ্যমে দেখানো হয় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার পথ। আসলে অনুসন্ধানে পাওয়া গেলে তার উল্টো চিত্র। চট্টগ্রাম কারাগারে যার যত বেশি প্রভাব, সে তত বেশি প্রভাবশালী। সাজাপ্রাপ্ত আসামীরাই এই প্রভাব কাটায় বেশি। নির্যাতন ও করেন নতুন বন্দিদের। তবে কারাগারের বাইরে এসব ঘটনা সহসা প্রকাশ করেন না কেউ। কারণ বেশির ভাগ হাজতি বিভিন্ন প্রকার অপরাধী হওয়ায় বারবার জেলে যেতে হয় বলে।

সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে এখন হাজতি-কয়েদি মিলিয়ে প্রায় ৮ হাজার ৩৩৫ জন বন্দি আছেন। বিশাল আয়তনের এই কারাগারের প্রাকৃতিক পরিবেশ বেশ ভালো। চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র এই কারাগারটিতে রয়েছে সুসজ্জিত একদল কারারক্ষী। বন্দিদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং উপার্জন করার মতন হাতের কাজও শেখার ব্যবস্থা করেছে কারাকর্তৃপক্ষ।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, কারাগার কর্তৃপক্ষ সব সময়ই সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলেন এবং তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করেন। যাতে কারাগারের ভেতর ও বাইরের নানা সমস্যার খবর প্রকাশ না পায়। অপরদিকে আসামীদের স্বজনেরা জানিয়েছেন, বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে আসলেই সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হন সাক্ষাৎ ঘরে। সেখানে ভালোভাবে কথা শোনা যায় না। কিন্তু কারারক্ষীদের সাহায্য চাইলে তারা আইনের বিভিন্ন অজুহাত তুলে ধরে দমকীও দেন এখানে। কিন্তু পকেটে হাজার টাকার নোট ঢুকিয়ে দিতেই তিনি সব আইনের কথা ভুলে যান। পরে দ্বিতীয়বারও দেখা করার ব্যবস্থা করে দেন।

জানা যায়, চট্টগ্রাম কারাগারের ধারণ ক্ষমতার চেয়েও প্রায় ৩ গুন বেশি বন্দি থাকায় খুব কষ্টে জীবন-যাপন করছেন তারা। কোন রকমে খাবার জোগাড় হলেও গাদাগাদি করে অবস্থান করায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। ৮ হাজার ৩৩৫ জন কয়েদির চিকিৎসা দিতে এই কারাগারে ডাক্তার আছেন মাত্র এক জন। অধিক সংখ্যাক অপরাধী বেড়ে যাওয়ায় কারাগারের আবাসিক সংকট প্রকট আকার ধারন করেছে। এবং অতিরিক্ত বন্দিদের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ।

অন্যদিকে জেলখানায় খাবারের মান খুবই নিম্নমানের বলে জানিয়েছেন একাধিক হাজতি। তবে সিঙ্গারা এখন পাঁচ টাকা নেন বলে জানিয়েছেন কিছু কয়েদি। তবে কারাকর্তৃপক্ষের দাবি, বন্দিদের উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। ক্যান্টিনে আগের মত বেশি বেশি দাম নেওয়া হয় না। বন্দিদের সকালে রুটি ও ডাল ডিম, দুপুরে সবজি-ডাল-ভাত এবং রাতে সবজি-ডাল-ভাত-মাছ বা মাংস খেতে দেয়া হয়। বন্দিরাও জেলারের কথা অস্বীকার করেননি। তবে তাদের অভিযোগ খাবারের নিম্মমান নিয়ে।

একাধিক বন্দি জানান, আমাদের খাবার তালিকায় যে ভাবে উল্লেখ থাকে তা দেয়া হয় না। সম্প্রতি, জেল থাকা বন্দি মো: মোর্শেদ খান জানান, তিনি ৮ মাস ধরে জেল খাটছেন। থাকার সংকটের কারণে কোনোদিন সোজা হয়ে ঘুমাতে পারেননি। কারাবিধি অনুযায়ী একজন বন্দির জন্য ৩৬ বর্গফুট আয়তন, ফাঁসির আসামির জন্য ৫৪ বর্গফুটের সেল এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি ও হাজতির জন্য ২৪ বর্গফুট স্থান বরাদ্দ। কিন্তু প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় আবাসন সংকট এখানে চরম আকার ধারণ করেছে বলে জানান কর্তৃপক্ষ।

একইভাবে ৩ বছরের অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছু আরেক আসামী জানান, একদিকে যেমন থাকার সংকট, অন্যদিকে পানি ও স্যানিটেশনের সমস্যা রয়েছে কারাগারটিতে। পানি সংকটের কারণে যে যার যার মত করে প্লাস্টিকের বোতলে পানি ভরে তা ব্যবহার করে। একবার টয়লেটে যেতে হলে প্রায় অনেক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, যা খুবই কষ্টকর।

সূত্রমতে, কারাগারের ভিতর বিভিন্ন ধরনের মাদক বিক্রির খবর ও পাওয়া গেছে, বাইরে থেকে এমন খবর শোনা গেলেও অনুসন্ধানে এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে কারাগারে মাদক বিক্রি হচ্ছে কি হচ্ছে না তা অন্য পর্বেই আপনাদের সামনে তুলে ধরব।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম কারাগারের অনিয়ম দুর্নীতির কারণে সাবেক জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস গত বছরের ২৬ অক্টোবর ৪৪ লাখ টাকা ও কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজনস) পার্থ গোপাল বণিক নয় মাসের মাথায় ৮০ লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার হন। টাকার উৎস খুঁজতে গিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ২৮ জুলাই ডিআইজি প্রিজনসকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক ও জেল সুপার সোহেল রানা বিশ্বাস। পরে প্রশান্ত কুমার বণিককে ৪ আগস্ট দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি চট্টগ্রাম কারা হাসপাতালের সহকারী সার্জন মোস্তাফিজুর রহমান ও ফার্মাসিস্ট রুহুল আমিনসহ কারাগারের ৪৯ কর্মকর্তার অনিয়মের তথ্য পেয়েছেন। তবে গত মাসের শেষের দিকে কারাগার পরিদর্শন শেষে দুদক পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, কারা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন খাতে মাসে অবৈধ আয় ৪০ লাখ টাকা। এরেই প্রেক্ষিতেই মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে দুদক এদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। দুদক গত মাসে ৩৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

জানতে চাইলে এই বিষয়ে চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার নাশির আহমেদ সকালের-সময়কে বলেন, কারাগারে এখন কোনো দুর্নীতি হয় না, আমি দায়িত্ব নেবার পর সব দুর্নীতিকে বিদায় জানিয়েছি, তবে দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট ৪৯ জনের মধ্য আপনার নাম আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি দুদকের পরিচালক ইউসুফের সাথে যোগাযোগে করতে বলেন।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ কামাল হোসেন সকালের-সময়কে জানান, আগের সেই জেলখানা এখন আর নেই, অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে এখানে, আশা করি আরো অনেক কিছু পরিবর্তন করবো কারণ সৎ, ও দায়িত্বপরায়ণ কর্মকর্তাদের এভাবেই নির্দেশনা দেওয়া আছে।

প্রিয় পাঠক! চট্টগ্রাম কারাগারের আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আগামী পর্বে চোঁখ রাখুন!

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ