ভুয়া বিলে কোটি টাকা আত্মসাত, ৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী বরখাস্ত


নিজস্ব প্রতিবেদক ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ১০:৫৩ : পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ভুয়া বিল-ভাউচারে ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি ঘটেছে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তার দফতর (এফএঅ্যান্ডসিএও) কার্যালয়ে। এ টাকা রেলওয়ের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

ভুয়া বিলে কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনাকে ঘিরে পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে রেলওয়ের সাত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তা মো. সাইদুর রহমান সরকার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, গত ৭ ফেব্রুয়ারি বাজেট ও খরচের হিসাব রিকনসিলেয়েশনকালে দেখা যায়, গত ২৮ ডিসেম্বর মেসার্স দি কসমোপলিটন করপোরেশন ঢাকার নামে তাদের চারটি বিলের অতিরিক্ত ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকার একটি সন্দেহজনক বিল পরিশোধ করা হয়েছে।

যা গুরুতর আর্থিক অনিয়মের পর্যায়ভুক্ত। উক্ত বিল পাস ও চেকের মাধ্যমে পরিশোধের সঙ্গে নিম্নবর্ণিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে সাত কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।

সাময়িক বহিষ্কার হওয়া সাত কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেন- রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের হিসাব কর্মকর্তা মামুন হোসেন, হিসাব কর্মকর্তা মো. আবু নাছের, হিসাবরক্ষক শিমুল বেগম, হিসাবরক্ষক সৈয়দ সাইফুর রহমান, অডিটর ডিএফএ পবন কুমার পালিত, জুনিয়র অডিটর ইকবাল মো. রেজাউল করিম ও অফিস সহায়ক মাকসুদুর রহমান।

রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভুয়া বিলে ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা আত্মসাতের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকে পূর্বাঞ্চল রেলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কমিটিতে প্রধান করা হয় চট্টগ্রামের বিভাগীয় হিসাব কর্মকর্তা (ডিএফএ) জয়শ্রী মজুমদার রশ্মিকে।

কমিটির বাকি তিন সদস্যরা হলেন- ডিএফএ সদর সুগ্রিব চাকমা, হিসাব কর্মকর্তা (ব্যয়) মো. জহিরুল ইসলাম ও অ্যাকাউন্টেন্ট আরসি মো. আব্দুল্লাহ আল আসিফ। কমিটিকে আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।

কমিটিকে বলা হয়, গত ২৮ ডিসেম্বর দি কসমোপলিটন করপোরেশন ঢাকার দাখিলকৃত একটি সন্দেহজনক বিল পরিশোধ করা হয়। যা জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত করা প্রয়োজন। সন্দেহজনক বিল কীভাবে পাস/পরিশোধ করা হলো বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা, এই বিল পরিশোধের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কার্যকলাপ যাতে আর সংঘটিত না হয় সে বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের কথাও উল্লেখ করা হয়।

রেলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের দফতর সূত্র জানা গেছে, গত অর্থবছরে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স দি কসমোপলিটন করপোরেশনের সঙ্গে বেশ কিছু চুক্তির মাধ্যমে মালামাল ক্রয় করা হয়। এর মধ্যে চারটি কাজের বিল বাবদ তিন কোটি ৬২ লাখ টাকা কসমোপলিটনকে পরিশোধের জন্য হিসাব বিভাগকে চিঠি দেন প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক ফরিদ উদ্দীন।

সে টাকা উত্তোলন করে নেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কসমোপলিটন। তবে সমস্যাটা সৃষ্টি হয় এ টাকার বাইরে আরও ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির নামে। রেলওয়ে কোনও সেবা কিংবা পণ্য না নিয়ে কোটি টাকা দিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে ঘিরে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক প্রকৌশলী ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স দি কসমোপলিটন করপোরেশন থেকে ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকার মামলার গ্রহণ করা হয়েছে- এ ধরনের কোন কাগজপত্র আমার দফতর থেকে হিসেব শাখায় পাঠানো হয়নি। হিসাব শাখার দফতরগুলোর যোগসাজশে এ টাকা লোপাট হয়ে থাকতে পারে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেলে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

এ প্রসঙ্গে কোতোয়ালি থানার ওসি এস এম ওবায়েদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রেলওয়ের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি নিয়ে কয়েকজন কর্মকর্তা থানায় এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা এ ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছেন। তদন্তে যারা দোষী বলে অভিযুক্ত হবেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স দি কসমোপলিটন করপোরেশনের নামে ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার নাবিল আহসান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনের কাছে দাবি করেন, দীর্ঘ ৫১ বছর ধরে আমার প্রতিষ্ঠান সুনামের সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়েতে ব্যবসায়িক কাজ করে আসছে।

রেলওয়েতে মালামাল সরবরাহ বাবদ প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্য টাকা গত ২৮ ডিসেম্বর চারটি চেকের মাধ্যমে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রদান করেছে। এর মধ্যে চেক নং- ১১৩৯৩০৪ এর অনুকূলে ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, ১১৩৯৩০৪ নম্বরের চেক বাবদ ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা, ১১৩৯৩০৬ নম্বরের চেকে ৯৬ লাখ ৪৪ হাজার টাকা এবং ১১৩৯৩০৭ নম্বরের চেক বাবদ ৭৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়।

তার দাবি, ২৮ ডিসেম্বর ইস্যু করা এ চারটি চেক নিয়ে রেলওয়ের কোনও অভিযোগ নেই। তাদের অভিযোগ পাঁচ নম্বর চেক নিয়ে। যেটি নাকি ইস্যু করা হয় ৩১ ডিসেম্বর। যার টাকার পরিমাণ ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা। তবে এ চেক কসমোপলিটন করপোরেশনের কোন কর্মকর্তা কিংবা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কেউ গ্রহণ করেননি।

এমনকি ব্যাংক থেকেও এ চেক প্রতিষ্ঠানটির কেউ নগদায়ন করেনি। আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে এ টাকা কে বা কারা আত্মসাৎ করেছে। এখানে আমার প্রতিষ্ঠানকে জড়িয়ে সুনামহানি করা হয়েছে।

নাবিল আহসান বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি চেক ইস্যু করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ পূর্বক চেক অনুমোদিত হয়। রেলওয়ে নির্দিষ্ট প্রাপক বরাবরে চেক ইস্যু করে থাকে। তা শুধুমাত্র কোম্পানির কর্ণধার অথবা তার অথরাইজড পারসনের কাছে যাচাই-বাছাই পূর্বক হস্তান্তর করা হয়।

এছাড়া বিল অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিলের কপি কন্ট্রাক্ট কপি, চালান, আর/নোট, ফরওয়াডিং দাখিল করতে হয়। অথচ ৩১ ডিসেম্বর ইস্যু হওয়া চেকের বিপরীতে কসমোপলিটন করপোরেশন থেকে কোন প্রকার কাগজপত্র দাখিল করা হয়নি।

নাবিল আহসান আরও বলেন, শুনেছি এ টাকার চেক অনুমোদন হওয়ার পর সোহাগ নামে এক ব্যক্তি সীমান্ত ব্যাংক চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা থেকে উত্তোলন করেছেন। যার ঠিকানা দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামের। আমার প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে এ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। অথচ সীমান্ত ব্যাংকের ওই শাখায় আমার প্রতিষ্ঠানের কোনও অ্যাকাউন্ট নেই। আমার অফিস চট্টগ্রামে নয়, ঢাকার ৩৮/১ নিউ ইস্কাটন রোডে।

এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তা মো. রফিকুল বারী খান বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কসমোপলিটন করপোরেশনের চারটি বিল ছিল। সেখানে একটি বিলের বিপরীতে দুইবার অর্থ ছাড় দেওয়া হয়েছে। ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে প্রাথমিকভাবে সাত জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই জন অফিসার, দুই জন অ্যাকাউন্টেন্ট, দুই জন অডিটর এবং একজন এমএলএসএস। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিস্তারিত জানা যাবে।

এসএস/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ