চরম দুর্ভোগে রোগীরা

বার বার বিকল চমেকের এমআরআই–মেরামত নিয়ে প্রশ্ন


নিজস্ব প্রতিবেদক ১৩ মে, ২০২৩ ১২:২২ : অপরাহ্ণ

গতবছরের (২০২২ সালের) মে মাসে হঠাৎ অকেজো হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের একমাত্র এমআরআই মেশিনটি। হিসেবে এরইমাঝে একবছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু অদ্যাবধি মেশিনটি সচল হয়নি। আর মেশিন সচল না হওয়ায় বছর ধরেই বন্ধ রয়েছে কম খরচের সরকারি এই এমআরআই সেবা।

এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা গরিব রোগীরা। বাধ্য হয়ে কয়েকগুণ বেশি ফি–তে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এই সেবা নিতে হচ্ছে তাদের। এতে করে গরিব–অসহায় রোগীরা আরো বেশি অসহায় হয়ে পড়ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেড নামের এক প্রতিষ্ঠান মেশিনটির সরবরাহকারী। অকেজো হওয়ার পরপর খবর দেয়া হলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এক দফা যন্ত্রাংশ যুক্ত করা হয়। তবে মেশিনটি সচল হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি পরে আরো যন্ত্রাংশ যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার কথা জানায়। মোটকথা সার্ভিসিংয়ের মাধ্যমে মেশিনটি সচল ও এর সেবা চালু যোগ্য হলেও মেশিনটি সচল করা যায়নি। আদৌ সচল হবে কী না, তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ওয়্যারেন্টি সময়সীমা শেষ হওয়ায় মেশিনটির সার্ভিসিংয়ের ক্ষেত্রে চুক্তি চায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেল প্রা. লি.। সার্ভিসিং বাবদ মেশিনের মোট মূল্যের ১০ শতাংশের বেশি ফি দাবি করে সিএমসি (কমিপ্রহেনসিভ মেইনটেন্যান্স কন্ট্রাক্ট) হিসেবে পরিচিত ওই চুক্তি করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই চুক্তির ক্ষেত্রে ৬.৫ শতাংশের বেশি ফি দিতে সম্মত নয়।

এমআরআই মেশিনটির মূল্য প্রায় দশ কোটি টাকা। হিসেবে ১০ শতাংশ ধার্য করলে কেবল মেশিনটির সার্ভিসিং বাবদ বছরে কোটি টাকা ফি দিতে হবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে। তাছাড়া প্রতি বছর এই হার (একটি নির্দিষ্ট হারে) বাড়তে থাকবে। ফলে দর কষাকষিতে এই চুক্তি আটকে আছে। চুক্তি না হওয়ায় মেশিনটিও সচল করছেনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।

হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে এমআরআই পরীক্ষা–নিরীক্ষায় ক্ষেত্র বিশেষে তিন হাজার ও চার হাজার টাকা ফি দিতে হয় রোগীকে। যা বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকার কম নয়।

মেশিনটি সচলকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দফায় দফায় চিঠি দিয়েছেন জানিয়ে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, আমরা সিএমএসডি (কেন্ত্রীয় ওষুধাগার) ও মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় চিঠি দিয়েছি। এখানে চুক্তির একটি বিষয় এসেছে। আমরা সেটিও চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছি।

কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সার্ভিসিং ফি বাবদ ১০ শতাংশের বেশি চায়। কিন্তু মন্ত্রণালয় ৬.৫ শতাংশের বেশি দিতে রাজি নয়। সার্ভিসিং ফির হারে দীর্ঘদিন ধরে এই চুক্তিটা আটকে আছে। এর মাঝে মন্ত্রণালয়ও ফি বাড়াতে রাজি হয়নি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটিও কমাতে রাজি না। সবমিলিয়ে চুক্তিটা না হওয়ায় আমরা (হাসপাতাল) বিপাকে পড়েছি। চুক্তি না হওয়ায় মেশিনটিও সচল করা যাচ্ছেনা।

এতে করে গরীব রোগীদের কষ্ট হচ্ছে স্বীকার করে হাসপাতাল পরিচালক বলেন, কয়দিন আগেও বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছি। এই অচলাবস্থা কাটাতে অনুরোধ করে আসছি। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নিয়মের বাইরে গিয়ে আমাদের কিছু করার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে হাসপাতালও অনেকটা অসহায় বলে মন্তব্য করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান।

এদিকে, বিষয়টি নিয়ে এর আগে মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেল প্রাইভেট লি. এর পঙ্কজ নামে দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি কথা বলতে চাননি।

প্রসঙ্গত, গত বছরের মে মাসে অচল হওয়ার পরপরই মেশিনটি সারাতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসে মেশিনটিতে ক্রিয় কমপ্রেসর (এডজারভারসহ) নামে একটি যন্ত্রাংশ সংযোজন করে। ওই যন্ত্রাংশ বাবদ ৫৪ লাখ ৯৫ হাজার (প্রায় ৫৫ লাখ) টাকার বিল দাখিল করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেল প্রা. লি.।

তবে ৫৫ লাখ টাকার যন্ত্রাংশ সংযোজনের পরও সচল হয়নি মেশিনটি। পরে ‘কোল্ড হেড’ নামে মেশিনটির অপর একটি যন্ত্রাংশ রিপ্লেসমেন্টের (পরিবর্তন) প্রয়োজনীয়তার কথা জানায় প্রতিষ্ঠানটি। আর এই যন্ত্রাংশের দাম উল্লেখ করা হয় ৪০ লাখ টাকা। ওয়্যারেন্টি সময়সীমা শেষ হওয়ায় মেশিনটির সার্ভিসিং বাবদ পুরো বিলই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করতে হবে।

এর প্রেক্ষিতে এমআরআই মেশিনটিতে নতুন করে ৪০ লাখ টাকার যন্ত্রাংশ সংযোজনের বিষয়ে মতামত চেয়ে ঢাকায় চিঠি দেয় চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গতবছরের ৭ জুলাই হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসানের স্বাক্ষরে ঢাকার নিমিইউ (ন্যাশনাল ইলেকট্রো–মেডিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ) এন্ড টিসির চিফ টেকনিক্যাল ম্যানেজার বরাবর এ চিঠি দেয়া হয়।

উল্লেখ্য, পুরনো মেশিন অকেজো হয়ে পড়ায় ২০১৪ সাল থেকে দীর্ঘ ৩ বছরের বেশি সময় এমআরআই সেবা বন্ধ থাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। তবে ২০১৭ সালে চমেক হাসপাতালে নতুন একটি এমআরআই মেশিন বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। জাপানী হিটাচি ব্রান্ডের (১.৫ টেসলা) নতুন এ মেশিনের মূল্য প্রায় দশ কোটি টাকা। মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেড নামে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান মেশিনটি সরবরাহ করে।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের (আগের) পাশে নতুন কার্ডিওলজি ভবনের নিচতলায় নতুন ওই এমআরআই মেশিনটি বসানো হয়। যদিও মেশিনটি হাসপাতালের তিনতলার রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের অধীনে। ইনস্টলেশন শেষে ওই বছরের (২০১৭ সালের) ২৪ অক্টোবর এ মেশিনের সেবা উদ্বোধন করা হয়। তবে উদ্বোধন হলেও ফিল্মের অভাবে ওই সময় পুরোদমে মেশিনটির সেবা চালু করা যায়নি।

পরবর্তীতে টেন্ডারের মাধ্যমে ফিল্ম ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে পুরোদমে এই মেশিনের সেবা চালু হয়। কিন্তু সেবা চালুর তিন বছর না যেতেই যান্ত্রিক ক্রটির কারণে ২০২০ সালের অক্টোবরে অচল হয়ে পড়ে মেশিনটি। দীর্ঘ সময় ধরে এমআরই সেবা বন্ধ থাকে চমেক হাসপাতালে। কম খরচের এমআরআই সেবা থেকে বঞ্চিত হন এ অঞ্চলের গরীব ও অসহায় রোগীরা। পরে ২০২১ সালের মে মাসে সার্ভিসিংয়ের মাধ্যমে মেশিনটি সচল করে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেড। ওই সময় মেশিনটি সার্ভিসিং বাবদ সাড়ে ৯ লাখ টাকা বিল করে প্রতিষ্ঠানটি।

তবে মাস না যেতেই ফের অকেজো হয়ে পড়ে প্রায় দশ কোটি টাকার এই এমআরআই মেশিন। এতে আবারো বন্ধ হয়ে যায় হাসপাতালের এমআরআই সেবা। এরপর থেকে দফায় দফায় মেশিনটি অকেজো হয়ে পড়ে। এরই মাঝে মেশিনটির তিন বছরের ওয়্যারেন্টি সময়সীমাও শেষ হয়ে যায়। আর ওয়্যারেন্টি সময়সীমা শেষ হওয়ায় মেশিনটির সার্ভিসিং বাবদ যাবতীয় খরচ এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই বহন করতে হয়।

যদিও সার্ভিসিং বাবদ ওই বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল ইলেকট্রো–মেডিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিইউ অ্যান্ড টিসি) থেকে অনুমোদন নিতে হয়।

দীর্ঘদিন মেশিনটি অকেজো থাকায় গরীব–অসহায় রোগীরা দুর্ভোগে পড়েছেন স্বীকার করে গরীব রোগীদের স্বার্থে মেশিনটি দ্রুত সচল করা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন হাসপাতালের রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুভাষ চন্দ্র মজুমদার।

সূত্র—ডিএ/এসএস/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ


You cannot copy content of this page