পূর্ব রেলের ‘যুবরাজ’ প্রকৌশলী আনোয়ার, অন্ধকারে দুদক!


নিজস্ব প্রতিবেদক ১৪ মার্চ, ২০২৪ ১:০০ : অপরাহ্ণ

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল জুড়ে তিনি ‘ধনী কর্মকর্তা’ হিসেবে পরিচিত। এই দপ্তরের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের একজন তিনি। সাবেক এক রেলমন্ত্রীর পরিচয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে করছেন চাকরি। সরকারি এই চাকরিতে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ থাকলেও কখনো হয়নি তদন্ত, হতে হয়নি শাস্তির মুখোমুখি।

এমনকি বিভাগীয় ব্যবস্থাও যেন তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সরঞ্জাম ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন, দরপত্রে কারসাজি, কমিশন বাণিজ্য, আধিপত্য, নিজস্ব ঠিকাদার সিণ্ডিকেট নিয়ন্ত্রণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কেবলই হাত বদল হয়েছেন তিনি। এক কর্মকর্তা থেকে আরেক কর্মকর্তা। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে রেলের অডিট রিপোর্টেও আছে তার নাম। এই ‘যুবরাজ’ আর কেউ নন। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিরেক্টর অব ইনভেন্টরি কন্ট্রোল (ডিআইসি) পরিচালক ও সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পূর্ব) সিআরবি’র দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি ঘুরেফিরে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে আছেন প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে।

ঠিকাদার সূত্রে জানা যায়, তিনি যেখানেই পদোন্নতি পেয়েছেন সেখানেই গড়ে তুলেছেন রামরাজ্য। রেলওয়ে জুড়ে তার প্রত্যক্ষ মদদে বিস্তার ঘটে কতিপয় ঠিকাদারদের দৌরাত্ম্যে। সরঞ্জাম কেনাকাটা, মালামাল সরবরাহ, বিক্রয় দরপত্রে তার মনোনীত ঠিকাদার ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ কাজ পায়নি।

জানা যায়, সরকার দুর্নীতি বন্ধে ২০০৮ সালে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট এবং ই-টেন্ডারিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু এ ধরণের ব্যবস্থা নিয়েও কোন ধরনের লাভ হচ্ছে না সরকারের। দেখা যাচ্ছে, সরকারি কেনাকাটায় বরং পুকুরচুরির ঘটনাই স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রকৌশলীদের বহু ধরণের কাজের গ্রাউন্ডে রেলের সরঞ্জাম দপ্তরে কেনাকাটা ও মালামাল সরবরাহে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে এমনটায় জানালেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সকালের-সময়কে বলেন, শত রকমের উপায় আছে রেলওয়েতে সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতি করার। টেন্ডারিং প্রসেসের মধ্যে কাউকে টেন্ডার পাইয়ে দিতে চাইলে মোটা অংকের ঘুষ আর কমিশন বাণিজ্যে হলেই দরপত্র আহ্বানকারী কর্মকর্তা নিজেই সব তথ্য ফাঁস করে দেন। যেমন–মনোনীত ব্যক্তিকে সব থেকে কম খরচ দেখানো, আগে থেকেই টেন্ডারের তথ্য ফাঁস করে দেয়া, দামের রেট বা হার বলে দেয়াসহ গোপনে এসবকাজ করেন প্রকৌশলীরা।

এদিকে রেলওয়ের এক ভুক্তভোগী ঠিকাদার সকালের-সময়কে জানান, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিরেক্টর অব ইনভেন্টরি কন্ট্রোল (ডিআইসি) পরিচালক ও সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পূর্ব) সিআরবি’র প্রকৌশলী মো. আনোয়ারুল ইসলাম প্রতিটি দরপত্রে তার মনোনীত ব্যক্তিদের কাজ পাইয়ে দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। রেলের মালামাল সরবরাহ, কেনাকাটা ও বিক্রয় দরপত্রে তিনি এমন ভাবে নয়ছয় করেন টেরও পান না কেউ।

তিনি আরও বলেন, সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পূর্ব) সিআরবি দপ্তরটি প্রকৌশলী আনোয়ারের হাতেই এক প্রকার জিম্মি। এ দপ্তরের সব কিছু ক্রয়-বিক্রয় ও সরবরাহের ক্ষমতা রয়েছে তার। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করার প্রতিযোগিতা করছেন। এছাড়া তিনি টেন্ডারের বৈশিষ্ট্য বা শর্ত এমনভাবে সাজান যাতে তার নির্দিষ্ট ব্যক্তিই ওই সুযোগটি পায়। আনোয়ার এ কাজে অনেক দক্ষ, অনেক রকমের পদ্ধতিও জানা আছে তার।

ঠিকাদাররা আরও বলেন, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের আওতাধীন সারাদেশের প্রায় ৩৯টি ডিপোর স্ক্র্যাপ পন্যের মালামাল বিক্রির একটি দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পূর্ব) সিআরবি প্রকৌশলী মো: আনোয়ারুল ইসলাম। ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে ১০ অক্টোবর ২০২৩ ছিল দরপত্র জমা দেওয়ার সর্বশেষ তারিখ। দরপত্র নং—৫৪.০১.১৫০০.৮৭.০০১.২২ বিক্রয় দরপত্রটি ওটিএম হলেও মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে তিনি তার সিণ্ডিকেটকে কাজটি পাইয়ে দিয়েছেন এমন গুঞ্জন রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শুধু এই দরপত্র নয় তার দপ্তরের প্রতিটি কেনাকাটার চাহিদাপত্রে তিনি লাখ লাখ টাকা কমিশন (ঘুষ) নেন।

এই বিষয়ে রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাজ পাইয়ে দিয়ে, দরপত্রের তথ্য ফাঁস করে দিয়ে, অনিয়ম-দুর্নীতি করা আসলে এটা দেশের জন্য সুখকর নয়। যারা দুর্নীতিবাজ তাদের শিখর মূলোৎপাটন করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে সজাগ হয়ে প্রকৌশলী আনোয়ারের বিরুদ্ধে তদন্ত করে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। এবং তার কার্যকলাপ নজরদারি করতে হবে। তার দপ্তরের সকল কাজের ফাইল তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এবিষয়ে জানতে ডিআইসি পরিচালক ও সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পূর্ব) সিআরবি প্রকৌশলী মো. আনোয়ারুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি উত্তেজিত হয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করেন, এবং নিউজ করলে দুনিয়া ও আখেরাতে জবাবদিহি করতে হবে বলে প্রতিবেদকে হুমকি দেন। এবং অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।

তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের অডিট আপত্তিতে উঠে আসে আনোয়ার ইসলামের প্রথম অনিয়ম-দুর্নীতির নানা ফিরিস্তি, তখন তিনি ছিলেন সহকারী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (ক্রয়-১) পাহাড়তলী। দূর্নীতির দায়ে তখন আনোয়ারসহ আরও ৬ জনের নাম উঠে আসে অডিট রিপোর্টে। এভাবেই আন-লিমিটেড ভাবে চলতেই আছে এই প্রকৌশলীর নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মেশিন। এরপরও তিনি শাস্তির বদলে পদোন্নতি পেয়ে হয়ে যান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পূর্ব) সিআরবি। এরপর হোন ডিরেক্টর অব ইনভেন্টরি কন্ট্রোল (ডিআইসি) পরিচালক।

সিআরবি সরঞ্জাম দপ্তর সূত্র জানায়, প্রকৌশলী আনোয়ার স্যারকে সরঞ্জাম দপ্তর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো শক্তি অন্য কোথাও বদলি করতে পারেনি, তার অনেক ক্ষমতা। সবমিলিয়ে বছরের পর বছর ধরে ঘুরেফিরে সরঞ্জাম দপ্তরেই আছেন তিনি। তাকে আবার রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা (সিসিএস) পাহাড়তলী হিসেব পদোন্নতি দিচ্ছে শুনেছি।

তিনি আরও বলেন, নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের মালিক প্রকৌশলী আনোয়ার স্যার, বিদেশেও টাকা পাচার করেন শুনেছি, বিদেশি একটি ফার্মের সাথেও চুক্তি ভিক্তিক কাজ করেন অনলাইনে। তিনি তার গ্রামের বাড়িতে কিনেছেন নামে-বেনামে জায়গা-জমি, ঢাকা শহরেও আছে বাড়ি। স্ত্রীর নামে ও আছে ব্যাংক ব্যালেন্স, ফ্ল্যাট, অঢেল সম্পদ।

প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলামের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) পার্থ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেনি।

উল্লেখ্য—এই প্রকৌশলীর অবিশ্বাস্য বাস্তবতা অবস্থা বোঝাতে এখন যেন আর হরিলুট, পুকুরচুরি, সাগরচুরি, কিংবা ‘ওলট-পালট করে দে মা লুটেপুটে খাই’—এমন সব প্রবাদ-প্রবচন আর যথেষ্ট বলে গণ্য হচ্ছে না। তাই জনমনে হতাশাসূচক প্রশ্ন, আমরা কোথায় যাচ্ছি!

এসএস/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ